কর্মজীবনে ঠিক দু’দিন ছুটি নিয়েছিলেন আবদুল কালাম
২৮ জুলাই ২০১৫, মঙ্গলবার
এপিজে আবদুল কালামের মা আসিআম্মা। তিনি ছেলেকে নিয়ে দেখতেন বড় স্বপ্ন। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন দিন আনি দিন খাই পরিবারে জন্ম নেয়া এই ছেলেটি একদিন এমন নাম করবে, যা পেরিয়ে যাবে সমুদ্র পেরিয়ে দূরে। তাই তিনি সংসারের নামমাত্র পুঁজি থেকে কিনতেন ছেলের পড়াশোনার জন্য বাড়তি কেরোসিন। তাতেই রাত জেগে আবদুল কালাম পড়াশোনা করতেন। কর্মজীবনে ঠিক দু’দিন ছুটি নিয়েছিলেন আবদুল কালাম। সেটা মায়ের আর বাবার মৃত্যুদিনে। বলে গিয়েছিলেন, আমার মৃত্যুতে ছুটি ঘোষণা করো না। আমায় যদি ভালবাসো, মন দিয়ে কাজ করো সে দিন।
ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে এভাবেই তুলে ধরা হয়েছে তার শৈশবকালের, কৈশোর আর জীবনের নানা প্রান্তের কথা। এতে বলা হয়েছেÑ আর সাত ভাইবোনের জন্য মা শুধু ভাত রাঁধতেন। কিন্তু ছোট ছেলেটার জন্য করতেন বাড়তি কয়েকটা রুটি। ভোর চারটেয় উঠে পড়তে বসবে সে। তখন খিদে পাবে তো। শুধু তা-ই নয়। দিন-আনি-দিন-খাইয়ের সংসারে নামমাত্র পুঁজি থেকে কিনতেন বাড়তি কেরোসিন। কত রাত পর্যন্ত ছেলে পড়াশোনা করবে কে জানে! লেখাপড়া শিখেই যে এই ছেলে অনেক দূর যাবে, ঠিক জানতেন মা। স্বপ্ন দেখতেন, তাঁদের বাড়ির খুব কাছেই যে বঙ্গোপসাগর, সেই বিশাল সমুদ্রও ছাড়িয়ে যাবে তাঁর ছেলের নামডাক।
মায়ের সেই স্বপ্ন সত্যি করেছিলেন আবদুল কালাম। তবে রাস্তাটা নেহায়েত সোজা ছিল না। ১৯৩১ সালের ১৫ ই অক্টোবর। তামিলনাড়–র রামেশ্বরমে এক অতি দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আবুল পাকির জয়নুল আবদিন আবদুল কালাম। বাবা জয়নুল আবদিন ছিলেন এক সাধারণ মৎস্যজীবী। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই রোজগারের তাগিদে খবরের কাগজ বিক্রি করতে হতো আবদুলকে। স্কুল পাশ করে কলেজে পড়ার জন্য একটা বৃত্তি পান তিনি। ভর্তি হন তিরুচিরাপল্লির সেন্ট জোসেফ কলেজে। ১৯৫৪ সালে সেখান থেকেই পদার্থবিদ্যায় স্নাতক। তার পর ফের স্কলারশিপ নিয়ে চেন্নাইয়ে। পড়তে শুরু করেন এয়ারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং। তার স্বপ্ন ছিল ভারতীয় বিমান বাহিনীতে বিমানচালক হবেন। তাঁর ক্লাসের প্রথম আট জনকে বিমানববাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। কালাম হয়েছিলেন নবম। সে-যাত্রায় তাই আর যুদ্ধবিমানের চালক হয়ে উঠা হয়নি কালামের।
বিমানচালক হয়ে ওঠা হল না। তবে নিজের অদম্য চেষ্টায় তিনি হয়ে উঠলেন দেশের ‘মিসাইল ম্যান’। ১৯৯৮ সালে পোখরান বিস্ফোরণ পরীক্ষার অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। পড়াশোনার জন্য একবারই শুধু গিয়েছিলেন বিদেশে, ১৯৬৩-৬৪ সালে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ‘নাসা’য়। যে বঙ্গোপসাগরের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নের জাল বুনতেন মা আসিআম্মা, সেই সমুদ্রসৈকতেই দু’দশক ধরে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল উৎক্ষেপণ করে গিয়েছেন তার ছেলে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ছিলেন ডিআরডিও, ইসরোয়। মহাকাশ ও পরমাণু গবেষণায় তাঁর অবদানের জন্য পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ ও ভারতরতেœ সম্মানীত হয়েছিলেন আবদুল কালাম। ২০০২ সালে ভারতের একাদশতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন তিনি। রাষ্ট্রপতি ভবনে ছিলেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত। তাঁর সময়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের দরজা সর্বসাধারণ, বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছিল। ছেলে-বুড়ো, বিজ্ঞানী-শিক্ষক সকলের কাছেই তিনি ছিলেন ‘সর্বসাধারণের প্রেসিডেন্ট’। মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি আবার ফিরে যান পড়াশোনার জগতে। শিলং, ইনদওর ও আহমদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, তিরুঅনন্তপুরমের ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে নিয়মিত পড়াতেন। এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মঞ্চেই বক্তৃতা দিতে দিতে তাঁর হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া তাই এক আশ্চর্য সমাপতন!
ধর্মের গোঁড়ামি এড়িয়ে চলতেন বাবা-মা। ছোটবেলা থেকে মুক্তমনা ছিলেন কালামও। গড়গড় করে মুখস্থ বলতে পারতেন ভগবদ্গীতা। পবিত্র কোরআন শরিফও। শুধু বইয়েই ডুবে থাকতেন না তিনি। তাঁর ঘনিষ্ঠরা জানাচ্ছেন, কোথাও যাওয়ার আগেই পকেট থেকে বার করে ফেলতেন ছোট্ট চিরুনি। নামজাদা হেয়ার স্টাইলিস্টের কল্যাণে তৈরি হয়েছিল তাঁর নিজস্ব চুলের ছাঁট। সব সময় বলতেন, লেখাপড়ার কোনও বিকল্প হয় না। স্কুলপড়–য়াদেরও বার বার অনুপ্রাণিত করে বলেছেন, নিজের ভবিষ্যতের কারিগর হতে গেলে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। আর কখনও কাজে ফাঁকি দেবে না। নিজের জীবনেও এ কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গিয়েছেন। কর্মজীবনে ঠিক দু’দিন ছুটি নিয়েছিলেন, মায়ের আর বাবার মৃত্যুদিনে। বলে গিয়েছিলেন, আমার মৃত্যুতে ছুটি ঘোষণা করো না। আমায় যদি ভালবাসো, মন দিয়ে কাজ করো সে দিন।