কবিতা, গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র ও শিল্পকলায় বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, যার কথাসাহিত্য ঘরে বাইরে প্রশংসিত হয়েছে, সুনাম বয়ে এনেছে, তার লেখায় পড়েছি কথাসাহিত্যিক যদি পাঠকের জীবনের ভিত নাড়িয়ে দিতে না পারেন, শিল্পী নিজে যদি বিপন্নবোধ না করেন, তাহলে তিনি কেমন কথাশিল্পী? যে লেখা আমাকে বিপদে ফেলবে না, আমি ঠিক আছি কিংবা এ ব্যাপারে সন্দেহ জাগাবে না, তেমন লেখার মূল্য কী? কবি ও কথাশিল্পী সৈয়দ শামসুল হক, তিনি ক’দিন আগে লোকান্তরিত হয়েছেন, এই খ্যাতিমান শিল্পী পুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে বসে বারবার কেবল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথাগুলো মনে পড়ছে। যে মানদণ্ড নিয়ে ইলিয়াস কথাশিল্পীর বিচার করতে চেয়েছেন, সেই মানদণ্ডের আলোকে বিচার করতে গেলে অনেকেই কথাশিল্পী হিসেবে খারিজ হয়ে যাবেন।
তাই অকপটে কবুল করে নিচ্ছি আমার জানা মতে, সৈয়দ শামসুল হক সমাজের ভিত কাঁপানো কোনো উপন্যাস লেখেননি। লিখতে পারেননি। হয়তোবা লিখতে চাননি। তবে তিনি যা দিয়েছেন, যা লিখেছেন তার পরিমাণগত দিক বিশাল। একদা অভিভক্ত বাংলায় মুসলিম জনসংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাদের কোনো অবস্থান ছিল না। উনিশ শতকের নবজাগরণে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। সবেধন নীলমণি মীর মোশাররফ হোসেন এবং তার সঙ্গে বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন, এ দু’জকে বাদ দিলে আর কোনো মুসলিম সাহিত্যকর্মীর সাক্ষাৎ মিলবে না। না, ভুল হচ্ছে, মহাশ্মাশানের মহাকবি কায়কোবাদকে এই তালিকায় রাখতে হবে। তা হলে সবেধন নীলমণি না বলে সবেধন তিনমণি বলাই সঙ্গত হবে। এরপর যারাই এ পথে পা বাড়াতে চেষ্টা করেছেন তাদের আগাতে হয়েছে অতি সতর্কতার সাথে, প্রকৃত নাম পরিচয় গোপন রেখে। তারপর পরিস্থিতির উন্নতি হয়। হাবিলদার নজরুল এসে দৃশ্যপটটা বদলে দিলেন। যত দিন সুস্থ ছিলেন একাই এক শ’ হিসেবে কাজ করে গেছেন। মুসলিম সমাজকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনুরাগী করে গেছেন। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁকে নজরুল যে দীর্ঘ পত্র লিখে সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে গেছেন তা কি এ দেশের সাহিত্যকর্মীরা গভীর অভিনিবেশসহকারে পড়ে দেখেছেন? আজ সে অবস্থা নেই। ঢাকা আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজধানী। বাংলা রাষ্ট্রীয় ভাষা। ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আড়াই লাখ ছাত্র-ছাত্রী উচ্চ শিক্ষা লাভ করছে। বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার সান্ত¡না পুরস্কার হিসেবে ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণায় কত বিরোধিতা করা হয়েছিল। আমরা সে কথা ভুলে যেতে চাই। আমাদের সামনে আরো দীর্ঘ পথ পড়ে রয়েছে। সেই পথ পাড়ি দিতে আমাদের পর্যাপ্ত পাথেয় লাগবে। সৈয়দ হক তার মেধা ও প্রতিভা দিয়ে যথেষ্ট পাথেয় আমাদের জন্য রেখে গেছেন। তিনি শেকড়ের সন্ধান করেছেন। দেশের মাটি ও মানুষ তার কণ্ঠস্বরে শক্তি জুগিয়েছে, তাই মাটি ও মানুষের জয়গান তিনি করে গেছেন। জমিদার শ্রেণী কৃষকের রক্ত চুষে নিঃস্ব করেছে বলে তাদের বিরুদ্ধে ‘নূরল দীনের সারাজীবন’ লড়াই চালাবার অমরগাথা রচনা করে গেছেন। এই বাংলার কৃষক জনতা সারা দিন খেতে-খামারে কাজ করে পরিশ্রান্ত হয়ে সন্ধ্যায় উঠোনে সমবেত হয়ে পুঁথি পাঠ করে তাদের রস পিপাসা মিটিয়েছে, শ্রান্তি দূর করেছে, সাহসে উদীপ্ত হয়েছে, সেই ভাষায়, সেই ভঙ্গিতে সেই ছন্দে কাব্যনাট্য লিখে সৈয়দ হক গরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। যে প্রত্যয় ও মূল্যবোধ নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে তার প্রতি আগাগোড়া বিশ্বস্ত থেকেছেন। এর মধ্যে আধুনিক চিন্তা-চেতনা যা তার অভিজ্ঞতায় এসেছে, তার সবটাই উজাড় করে দিয়ে গেছেন তার বিচিত্র সৃষ্ট সম্ভারে। যাতে বাঙালির সংস্কৃতির মান আরো এগিয়ে যায়, আরো উন্নত হয়। এজন্যই তিনি বাঙালি সংস্কৃতির অহঙ্কার।
মেধাবী সাহিত্য সমালোচকের অভাবে আমাদের কবি নাট্যকার, কথাশিল্পী এক কথায় সাহিত্যকর্মীদের যথার্থ মূল্যায়ন হচ্ছে না, ফলে তারাও তাদের প্রকৃত স্বরূপ চিনতে পারছেন না। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ লোকান্তরিত হওয়ার কারণে আমাদের সমালোচনা সাহিত্য অসম্ভব দুর্বল হয়ে পড়েছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যুতে আলোচ্য ক্ষেত্রটি আরো নাজুক হয়ে পড়ল। কারণ তিনি কেবল কবিতা, নাটক, উপন্যাস লেখেননি, সিনেমার স্ক্রিপট লিখেছেন, গান লিখেছেন, সাহিত্য সমালোচনাও করেছেন। এমনকি সংবাদপত্রে কলামও লিখেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কিছুই লেখা হয়েছে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র ও শিল্পকলায় বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। তার পরও আবুবকর সিদ্দিকের মতো বরেণ্য কবি ও কথাশিল্পী আক্ষেপের সুরে বলেছেন, গোলাম কুদ্দুসের ‘লেখা নেই স্বর্ণাক্ষরে’-এর মতো একটি আন্তরিক ও নিরীহ লেখা কেউ লেখেননি। নিশ্চয়ই ফাঁক ছিল কোথাও। সমগ্র জাতির যুগ-যন্ত্রণা বুকে ধারণ করার মতো লেখকের অভাবে যদি সত্যিকারের বড় মাপের লেখা না বেরিয়ে থাকে তবে ব্যাপারটা নিতান্তই দুঃখজনক। তবে আমাদের অনেক বাধা ডিঙ্গিয়ে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। এমন একটা সময় গেছে যখন অন্য সবার দিন হলেও আমাদের ছিল রাত। নাম বদলে, পরিচয় গোপন করে শিল্পী ও সংস্কৃৃতি কর্মীদের কাজ করতে হতো। একাত্তরের পর আমরা স্বাধীন হলাম এবং জানতে পারলাম বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ। আমরা ধাক্কা খেলাম। আমাদের স্বপ্নভঙ্গ, আমাদের অন্তরলোকের রূপান্তর, আমাদের ভাঙা-গড়া, উত্থান-পতনের রাজনীতির, আমাদের জীবনযুদ্ধ, সবই বিষয় হিসেবে জটিল এবং নাটক ও কথাসাহিত্যের চমকপ্রদ উপাদান। কিন্তু এসব উপাদানকে কাজে লাগিয়ে কথাসাহিত্যের গল্প সাজানো কিংবা নাটকে এসবের মুখোমুখি হওয়ায় জন্য যে সহনশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ অপরিহার্য, তার অভাব আমাদের সাহিত্যকর্মকে উঁচু মানের হতে দেয়নি। এর ফলে দর্শক, পাঠক, সমালোচক এবং পৃষ্ঠপোষকের অভাবকে বিবেচনায় নিয়ে বিচার করলে যারা তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখার চেষ্ট করেছেন তাদের সাধুবাদ জানাতে হবে। একাত্তরের আগ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আমাদের চিন্তা-চেতনা আবর্তিত বিবর্বিত হয়েছে। এর ফলে মাতৃভাষার অবস্থান উন্নীত হলেও ভাষার শৈল্পিক উৎকর্ষ তেমন সাধিত হয়নি। এ কথা আমার নয়, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের। বস্তুত, ভাষার উৎকর্ষের জন্য সাংস্কৃতিক মানের উৎকর্ষ প্রয়োজন। সংস্কৃতির মান নির্ভর করে অর্থনৈতিক বিকাশের ওপর। আগেই বলেছি, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার একটা শক্ত ভিত্তি তৈরি হতে থাকে। কবি, সাহিত্যিকেরা আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করতে শুরু করে। সেই আত্মবিশ্বাস থেকেই স্বাধীন সত্তা অর্জনের স্বপ্ন অঙ্কুরিত হয়। কিন্তু সাহিত্য সৃষ্টির জন্য চাই পর্যাপ্ত অবকাশ, যা চিরস্থায়ী বন্দবস্তের পর মধ্যস্বত্ব ভোগী শ্রেণী পেয়েছিল। একাত্তরের পর বারুদপোড়া বাংলাদেশে তেমন স্বস্তি ও অবকাশ ছিল দুর্লভ। লেখক-সাহিত্যিকেরা তা পায়নি। কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ তার উপস্যাসে যে জীবন দর্শন ও অভিজ্ঞতার শিল্পরূপ দিতে পেরেছেন তা সম্ভব হয়েছে বিদেশের নিরুদ্বিগ্ন পরিবেশে অবস্থান করার কারণে। একই কথা প্রযোজ্য সৈয়দ শামসুল হকের ক্ষেত্রেও। বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রচার মাধ্যমের সাথে সম্পৃক্ত থাকার সুবাদে তিনি তার সাহিত্য পরিকল্পনার ছক বিভিন্নভাবে সাজাবার চিন্তা করতে পেরেছেন এবং আঙ্গিক ভাঙার ঝুঁকি নিতে সাহস পেয়েছেন। উপস্থাপনার কৌশল বদলের অবকাশ পেয়েছেন। বিদেশে অবস্থানকালে তিনি মাইকেলের অভিজ্ঞতাকে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। মাইকেল মাতৃভাষায় মণিমুক্তোর সন্ধান পেয়েছিলেন সংস্কৃতঘেঁষা বাংলা শব্দের মধ্যে। আর মানবিক চিন্তা পেয়েছিলেন ইংরেজি সাহিত্য পাঠ করে। তিনি মেঘনাধ বধ কাব্য লিখে চমকে দিয়েছিলেন বাঙালি পাঠক সমাজকে। আর সৈয়দ হক মাতৃভাষায় মণিমুক্তোর সন্ধান পেয়েছিলেন দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের মধ্যে। ঐতিহ্যের অনুরাগী সৈয়দ হক খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন পুঁথির ভাষায় ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ এবং ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ কাব্যনাট্য লিখে। ‘খেলারাম খেলে যা’ তার বহুল পঠিত এবং আলোচিত উপন্যাস। যৌন সুড়সুড়ি দিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার কৌশল তিনি জানতেন। তার উপন্যাসের সংখ্যা অনেক। ‘এক মহিলার ছবি’, ‘স্তব্ধতার অনুবাদ’, দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’, ‘নীল দংশন’, ‘নিষিদ্ধ লোবান, ‘বালিকার চন্দ্রযান’, ‘তুমি সেই তরবারি’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ ইত্যাদি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী অভিজ্ঞতা, প্রবাসী বাঙালিদের জীবন ও সমস্যা সৈয়দ হকের কথাসাহিত্যের উপজীব্য। প্রচুর লিখতে গেলে সব সময় বিষয়ের প্রতি সুবিচার করা কঠিন হয়। এ ছাড়া একাধিক সাপ্তাহিক পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় উপন্যাস পত্রস্থ করার তাগিদ পূরণ করতে গিয়েও তিন তুড়ি দিয়ে শিব পুজো সারতে হয়েছে তাকে এবং আরো অনেককে। তার পরও যারা প্রতিভাবান লেখক তাদের রচনায় এমন কিছু থাকে যা চেষ্টা করেও অন্যেরা লিখতে পারে না।
ক’দিন আগেও সৈয়দ শামসুল হক আমাদের মাঝে ছিলেন। আজ তিনি স্মৃতি। ‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ’- সেই মহৎ মানুষটিকে হারিয়ে আমরা অনেকটা নিঃস্ব হয়ে গেলাম। পঞ্চাশের দশকে যারা কবিতাকে জীবনের অংশ করতে চেয়েছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন সৈয়দ হক। ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার মেধাবী কারিগর ছিলেন সৈয়দ হক ও তার সঙ্গীরা। কবিতার সাথে রাজনীতি ও স্বদেশ চর্চা সমানে করতেন তারা। রাবিন্দ্রীক উত্তরাধিকার ভেঙে খাওয়ার দিন আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কবি নজরুল ইসলাম তাকে অতিক্রম করেছিলেন বিদ্রোহের পথে, আর কবি জীবনানন্দ দাশ বিবর্তনের পথে।
তিরিশের অন্য প্রধান কবিরা অনেক বেশি পাশ্চাত্যের প্রতি মুগ্ধ ছিলেন। ঢাকাকেন্দ্রিক কবিরা ততটা পাশ্চাত্যপ্রেমিক ছিলেন না। অবশ্য অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ তাদের পাশ্চাত্যের দিকে তাকাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা তখনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক কারণে কলকাতার সাথে যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গেলেও অনেকের মধ্যে কলকাতার প্রতি একটা মুগ্ধতা থেকে গিয়েছিল। নতুন বাস্তবতায় আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে কিছুটা সময় লেগেছিল। সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় যারা এগিয়ে ছিলেন, তাদের অভিযোগ ছিল মুসলিম কবি-সাহিত্যিকেরা ধর্ম চিনল, দেশকে চিনল না, ভাষাকে চিনল না। এ অভিযোগের উত্তর এলো ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের কাছ থেকে। তারপর ইতিহাসের গতিধারা বদলে গেল। নতুন জীবন দর্শন চালকের আসনে বসল। একাত্তরে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বিশ্ব প্রগতির ধারায় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটল। বিশ্বের কাছে নতুন গুরুত্ব নিয়ে আবির্ভূত হলো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। তখন কলকাতার কবি-সাহিত্যকদের প্রশংসাপত্র অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল। গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জাতীয় পুনর্গঠনে নেতৃত্ব দিতে শুরু করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ভুগোলের ভাগ হলেও মনের মানচিত্র ভাগ হয় না- এ কথা যারা বলেন তারা ভুলে যান ভাগাভাগির কারণে আশা-আকাক্সক্ষা, ভাষা ও সংস্কৃতি সবকিছু বদলে যায়। স্বাধীনতা অর্জনের আগে ও পরে আমরা সেটাই হতে দেখেছি।
এ সময় ঢাকার নাট্যমঞ্চে, ঢাকার কবিতায়, ঢাকার কথাসাহিত্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। কবি শামসুর রাহমান, কবি আল মাহমুদ, কবি সৈয়দ শামসুল হক, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি রফিক আজাদ, কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ূন আহমেদ এবং আরো অনেকে ঘরে-বাইরে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করতে শুরু করেন। সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসটি বহুল আলোচিত এবং পঠিত হলো। তার ‘নীল দংশদ’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কথাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করল। খণ্ড কবিতায় তিনি দারুণ মুনশিয়ানা দেখালেন। তার কাব্যনাট্য ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ এবং ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য সৃষ্টি হিসেবে সংযোজিত হলো।
সৈয়দ হক কেবল লেখক নন, নিষ্ঠাবান পাঠকও বটে। বাংলা সাহিত্যের চর্চাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় পুঁথি সাহিত্য এবং আধুনিক সাহিত্যের বিপুল সৃষ্টিসম্ভার তিনি নিষ্ঠার সাথে পড়েছেন। ইংরেজি সাহিত্যের সাথেও গভীর সংযোগ রক্ষা করেছেন। ব্যাপক পঠন-পাঠনের সার নির্যাস আত্মস্থ করে তিনি তার পাঠকের রুচি ও সাংস্কৃতিক মানের সাথে সঙ্গতি রেখে নিজের সৃষ্টিকে পরিবেশন করেছেন। ঐতিহ্যের প্রতি গভীর অনুরাগ, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের প্রতি বিশ্বস্ততা তাকে জনপ্রিয় কবি ও কথাশিল্পী হতে সাহায্য করেছে। ভাষা নিয়ে, আঙ্গিক নিয়ে তিনি নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত সৃজনশীল থাকার চেষ্টা করে গেছেন। তার মৃত্যুর পরে দেশের বিদ্ব্যৎ সমাজ তাকে শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হয়েছে। তার জীবন থেকে পরিশ্রমী হওয়ার, সৃজনশীল হওয়ার এবং ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগী হওয়ার প্রেরণা পাবে নতুন প্রজন্ম।
সমাজে যখন অন্যায় অবিচার বেড়ে যায়, সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে পড়ে দুর্বিষহ, তাদের আশা-আকাক্সক্ষা স্বপ্ন হয় পদদলিত, তখন সেই আশা, আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার দায়-দায়িত্ব এসে পড়ে শিল্পী সামাজের কাঁধে। তাদের দল, মত, বিশ্বাস বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে সমাজে যে বিষাক্ত দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে তা কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠ হওয়ার সাহস বা হিম্মৎ যিনি শিল্পী পুরুষ তিনি রাখেন কিনা? অমৃত এবং হলাহল একসাথে কণ্ঠে ধারণ করার দক্ষতাই শিল্পীকে ইতিহাসে অমর করে রাখে। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ কাব্যনাট্যের একটি লাইন উদ্ধার করে আলোচনা শেষ করছি।
‘আর আজ লোক নাই
এতগুলো লোকের ভিতরে’?