ওসি মোয়াজ্জেমের আট বছর কারাদণ্ড, নুসরাতের জবানবন্দির ভিডিও প্রচার, সাইবার ট্রাইব্যুনালের রায়
নুসরাতের জবানবন্দির ভিডিও প্রচার, সাইবার ট্রাইব্যুনালের রায়
ওসি মোয়াজ্জেমের আট বছর কারাদণ্ড
সোনাগাজী মডেল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনকে ৮ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে তাকে ১৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডেরও আদেশ দেন আদালত। ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ডের পর তার বিরুদ্ধে এ মামলা হয়। হত্যাকাণ্ডের আগে মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ দিতে থানায় গেলে ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতকে বিব্রতকর প্রশ্ন করে তার ভিডিও ধারণ করেন। পরে ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয় । অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলার জেরে নুসরাতকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টা চালায় অধ্যক্ষের অনুসারীরা। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নুসরাত। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হয়।
রায়ে অধ্যক্ষ সিরাজসহ ১৬ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
গতকাল বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আস-শামস জগলুল হোসেন ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলার রায় ঘোষণা করেন। এই আইনের ২৬ ধারায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। ২৯ ধারায় তিন বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, তথ্য প্রযুক্তি আইন বিলুপ্ত হয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ হওয়ার পর এই প্রথম এই আইনে কোনো মামলার রায় হলো। রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও মামলার বাদী সন্তোষ প্রকাশ করলেও সংক্ষুদ্ধ আসামির আইনজীবী রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানান।
মোয়াজ্জেমকে কড়া নিরাপত্তায় ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতে আনা হয়। তাকে রাখা হয় সেখানকার গারদখানায়। বেলা সোয়া ২টার দিকে মোয়াজ্জেমকে কড়া নিরাপত্তায় আদালতের এজলাসে হাজির করা হয়। এরপর দুইটা ২০ মিনিটে আদালত রায় পড়া শুরু করেন। রায় ঘোষণার সময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন মোয়াজ্জেম। রায়ে দণ্ড শোনার পর কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত থাকেন তিনি। একপর্যায়ে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে কাঠগড়া থেকে বেরিয়ে আইনজীবীর সঙ্গে কয়েক সেকেন্ড কথা বলেন তিনি। এরপর কড়া নিরাপত্তায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। ঢাকার আদালতের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি প্রসিকিউশন) জাফর হোসেন জানান, রায়ের পর মোয়াজ্জেমকে বিচলিত মনে হয়নি।
এদিকে, রায়ের পর মামলার বাদী ব্যারিস্টার সাইয়েদুল হক সুমন বলেন, আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। এই রায় দেশের সকল থানার ওসিদের জন্য একটি সতর্ক সংকেত যে, কেউ অপরাধ করলে তাকে বিচারের আওতায় আসতে হবে। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম শামীম। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের অক্টোবরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চালু হওয়ার পর এই আদালতে প্রায় ১শ ৫০টির মতো মামলা এসেছে বিচারের জন্য। এর মধ্যে এই আইনে এটিই প্রথম কোনো মামলার রায় হলো। আসামির বিরুদ্ধে তিনটি ধারায় অভিযোগ আনা হলেও একটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। দুটি ধারায় তাকে আট বছর সাজা দিয়েছে আদালত। রায়ে আমরা সন্তোষ্ট। আশা করি উচ্চ আদালতেও এই রায় বহাল থাকবে। তবে, আসামি মোয়াজ্জেম হোসেনের আইনজীবী ফারুক আহমেদ বলেন, আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করব।
এর আগে গত ২০শে নভেম্বর রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য ২৮শে নভেম্বর দিন ধার্য করেন বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আস-শামস জগলুল হোসেন। এ মামলায় ১২ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন। গত ১৭ই জুলাই ট্রাইব্যুনালে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ১৭ই জুন আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ১৬ই জুন রাজধানীর শাহবাগ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ট্রাইব্যুনালের বিচারক পিবিআইয়ের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে ২৭শে মে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
গত ৬ই এপ্রিল সোনাগাজীতে স্থানীয় ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে ওই মাদ্রাসার সাইক্লোন সেন্টার ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় অধ্যক্ষ সিরাজের সহযোগীরা। ঘটনার চার দিন পর ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এর আগে নুসরাতকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে তার মা শিরিন আক্তার সোনাগাজী থানায় ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ (পরে বরখাস্ত) সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার পর ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতের জবানবন্দি নেয়ার সময় তাকে নানা বিব্রতকর প্রশ্ন করে তার ভিডিও করেন নিজের মোবাইল ফোনে। পরে সামাাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেয়া হয়। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠে। খুনীদের পাশপাশি ওসি মোয়াজ্জেমকে আইনের আওতায় আনার দাবি উঠে মুখে মুখে। এমন অবস্থায় তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন আইনজীবী সায়েদুল হক সুমন। এ মামলায় গ্রেপ্তার হন ওসি মোয়াজ্জেম।