এবার শ্রমিকদের প্রতি একটু সহানুভূতি দেখান ॥ শেখ হাসিনা
অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পোশাক শিল্প মালিকদের উদ্দেশে বলেছেন, শ্রমিকরা রক্ত ও ঘাম ঝরিয়ে টাকা উপার্জন করে। সেই টাকায় আপনারা বিত্তবৈভব গড়ে তুলেছেন। এবার সেই শ্রমিকদের জন্য একটু সহানুভূতি দেখান। তিনি বলেন, আপনারা দুইটা স্যুট-প্যান্ট কম পরলে তেমন ক্ষতি হবে না। কিন্তু সেই টাকায় দুই বেলা খাবার পেলে শ্রমিকরা আরও উৎসাহ নিয়ে আপনাদের কাজ
করে দেবে। একই সঙ্গে যে কোন ধরনের প্ররোচনার বিরুদ্ধে শ্রমিক ও মালিক উভয়কে আরও সতর্ক থাকার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) আয়োজিত বাংলাদেশ এ্যাপারেল এ্যান্ড টেক্সটাইল এক্সপোজিশন (বাটেক্সপো) উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় ২৪তম এ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। অনুষ্ঠানে এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের, বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বক্তব্য রাখেন।
শ্রমিকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা যে কারখানায় কাজ করেন, যে কারখানা আপনাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের অর্থ যোগায় সে কারখানা কারও প্ররোচনায় ধ্বংস করবেন না। এতে আপনারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, চাকরি হারাবেন। গার্মেন্টস খাত নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় মালিক ও শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। মালিক ও শ্রমিক একে অপরের পরিপূরক এ কথা মনে রাখতে হবে। সম্প্রতি দেশের গার্মেন্টস শিল্পের দুর্ঘটনার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাপী শিল্পের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শিল্প দুর্ঘটনা। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। এতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। তিনি মানোন্নয়ন ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে আন্তরিক হতে গার্মেন্টস উৎপাদকদের প্রতি আহ্বান জানান। ন্যূনতম মজুরির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে ২০১০ সালে ন্যূনতম মজুরি ১৬০০ টাকা থেকে ৮২ শতাংশ বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করেছিলাম। নিয়মানুযায়ী পাঁচবছর অন্তর মজুরি বোর্ড গঠনের কথা থাকলেও তিন বছরের মধ্যে আবারও মজুরি বোর্ড গঠন করে দিয়েছি। বোর্ড সুপারিশ করুক। তারপর আমার যেটা করার সেটা আমি করব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর ’৯৬ সালের সরকারের সময়েই পোশাক শিল্পে বিকল্প সিঁড়ি নির্মাণ বাধ্যতামূলক করা হয়। এর ভিত্তিতে কারখানাগুলো তাদের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ সক্ষমতা গড়ে তোলে। পাশাপাশি দেশব্যাপী অনেক নতুন উদ্ধার উপকরণসহ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে শক্তিশালী করা হয়। শেখ হাসিনা দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকা- ও ভবন ধসে নিহত শ্রমিকদের স্মৃতির প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা জানান। একই সঙ্গে তিনি এসব ঘটনায় আহত শ্রমিকদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তাদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। তিনি বলেন, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার সময় দেশের বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীরা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হয়রানির ভয়ে হাত গুটিয়ে বসেছিলেন। সে সময় বৈশ্বিক মন্দার কারণে দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী গার্মেন্টস খাত প্রতিকূল অবস্থায় পড়েছিল। এই অবস্থায় তাঁর সরকার শুরুতেই ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও রফতানিকারকদের মাঝে আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনে। মন্দা মোকাবেলায় ও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে জাতীয় বাজেটে গার্মেন্টস খাতের জন্য কর রেয়াতসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সংবলিত প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়।
শিল্পের প্রসারে অবকাঠামো উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ লক্ষ্যে বিদ্যুত ও গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়া হয়। সড়ক, রেল ও নৌ যোগাযোগের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার ও বাইপাস নির্মাণের ফলে পণ্য পরিবহন সহজ হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার বেসরকারী খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি শিল্পনীতি প্রণয়ন করেছে। নতুন রফতানি পণ্য ও নতুন বাজারের জন্য প্রণোদনা দিচ্ছে। এছাড়া মংলাবন্দর খুলে দেয়া এবং চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়ন ও দক্ষতা জন্য কন্টেনার টার্মিনাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করা সরকারের কাজ নয় দাবি করে শেখ হাসিনা বলেন, তবে তাঁর সরকার ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে। ১৯৯৬ সালে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের মেয়াদে গার্মেন্টস খাতের উন্নয়নে ৬২ রকমের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার ১৯৯৬ সালে বিগত বিএনপি সরকারের সময়ে সৃষ্ট জিএসপি সমস্যার সমাধান করেছিল। তিনি বলেন, তখন ভয়াবহ বন্যা সত্ত্বেও দেশে রফতানি বাধাগ্রস্ত হয়নি। তিনি বলেন, তখন বেসরকারী রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) প্রতিষ্ঠায় একটি আইন পাস করা হয়েছিল। নতুন ইপিজেডগুলো প্রতিষ্ঠার সময় ঢাকা ও চট্টগ্রাম রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলও সম্প্রসারিত করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের মালিকদের ‘বিল্ডিং কোড’ মেনে চলার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কারখানাগুলোর ত্রুটি খুঁজে বের করতে গঠন করা হয় বিশেষ কমিটি। তাছাড়া শিল্প-কারখানায় দুর্ঘটনার বিষয়ে মালিক-শ্রমিকদের সচেতন করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় এবং নিয়োগ দেয়া হয় নতুন পরিদর্শক।
শেখ হাসিনা বলেন, গার্মেন্টস শিল্পের জন্য ভবনের জায়গা ব্যবহারের ওপর সরকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট রেয়াত দিয়েছে। তিনি বলেন, পরিবেশগত দূষণ রোধে ইটিপি যন্ত্রপাতি আমদানি শুল্কমুক্ত করা হয়েছে। ‘ইটিপি’র রাসায়নিক উপাদান আমদানিতে সকল ধরনের শুল্ক ও মাসুলের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশের বেশি রেয়াত দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুদ্রাস্ফীতির চাপ থেকে রেহাই দিতে সরকার গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের রেশনিং চালু করেছে। এছাড়া গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য সরকার স্থায়ী রেশনিং ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি আশা করেন, যে কারখানা মালিকরা তাদের উৎপাদন বাড়াতে শ্রমিকদের আরও সুযোগ-সুবিধা দেবেন। এতে শ্রমিক ও মালিক উভয়পক্ষ উপকৃত হবেন, পাশাপাশি দেশও লাভবান হবে। শেখ হাসিনা বলেন, শ্রমিক ও কারখানা একে অপরের পরিপূরক। সে কারণে কারখানা বন্ধ করে দেয়ার যে কোন ধরনের প্ররোচনার বিরুদ্ধে শ্রমিক ও মালিক উভয়কে আরও সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, কারখানার কোন ধরনের ক্ষতি কেউই মেনে নিতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, গার্মেন্টসে নারীদের কাজ করতে দেয়া হবে না। এ রকম এক ‘তেঁতুল তত্ত্ব’ বাজারে এসেছে। আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী তাতে সমর্থনও দিয়েছেন। এ রকম কোন তত্ত্বেই কাজ হবে না। আপনারা শুধু সতর্ক থাকবেন যাতে কোন বিশৃঙ্খলা না হয়। শেখ হাসিনা বলেন, গ্যাসের চাপ বাড়ানোর জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিদ্যুতে আর কোন সমস্যা নেই। এ উন্নয়ন ধরে রাখার জন্য সরকারের ধারাবাহিকতা দরকার বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, এমনিতেই নতুন কারখানা করলে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে কিছুটা সুবিধা আপনারা পেয়ে থাকেন। তবুও মুন্সীগঞ্জের বাউশিয়ায় গার্মেন্টস পল্লী ও সেখানে কারখানা নির্মাণে নির্মাণ সামগ্রী শুল্কমুক্ত আমদানির যে দাবি আপনারা করেছেন তা আমি বিবেচনা করব।
বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর কাছে চারটি দাবি তুলে ধরেন, এগুলো হলো- উৎসে কর দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ২০ শতাংশ করা, পোশাক রফতানি থেকে পাওয়া ডলারের বিশেষ বিনিময় মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া, পোশাক শিল্পের জন্য একক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং গার্মেন্টস পল্লীতে কারখানা নির্মাণে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ সামগ্রী শুল্কমুক্ত আমদানির সুযোগ প্রদান। এছাড়া শ্রমিকদের রেশনিং পুনরায় চালু, বাড়িওয়ালাদের দৌরাত্ম্য কমানো এবং শ্রমিকদের ডরমিটরি প্রতিষ্ঠার দাবিও জানান তিনি। বিজিএমইএ’র বিভিন্ন দাবি-দাওয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উৎসে কর দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব আপনারা করেছেন। এত তো কমানো সম্ভব নয়; তবে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে কিছুটা কমাতে পারব বলে আশা করছি। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত প্রথম সহ-সভাপতি এমএ ওয়াহাব, সহসভাপতি এসএম মান্নান কচি, রিয়াজ বিন মাহমুদ সুমন প্রমুখ।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার থেকে তিন দিন চলবে এ প্রদর্শনী। এবারের প্রদর্শনীতে ৮০টি স্টলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, এক্সেসরিজ, বস্ত্র, প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন পণ্য প্রদর্শন করা হবে। আর বিভিন্ন দেশ থেকে বায়ার হিসেবে দর্শকরা এসেছেন। গত বছরের ন্যায় এবারও বাটেক্সপোকে ‘সাদাকালো’ বলছে বিজিএমইএ। গতবার তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকা-ের পর ‘সাদাকালো’ বাটেক্সপো অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবার সাভার ট্র্যাজেডির স্মরণে প্রদর্শনীকে ‘সাদাকালো’ বলা হচ্ছে।