এতই আপত্তি
কোনো কারণে জয়নবের মন খারাপ হলেই সে তার প্রিয় পোষা পাখি টুকটুক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়, এটা এখন তার নিয়মিত বিষয় যা বাড়ির সবারই জানা। এ সময় কেউ তাকে ঘাটাতে সাহস পায় না। এমনকি তার বাবাও না। কিন্তু আজ তার বাবা স্থির থাকতে পারলেন না, বিরক্তিতে মুখটা কুচকে আছে, এবার নিয়ে তৃতীয়বার মোবাইলে রিং বাজার সাথে সাথেই বিরক্তিসহকারে জয়নবের দিকে তাকালেন আলী হোসেন, কোনো কারণ ছাড়া যদি কেউ ফোন রিসিভ না করে অহেতুক কালক্ষেপণ করে তখন তার মেজাজটা খিঁচড়ে যায়, মনে হয় কেউ যেন তার মাথার ভিতরেই রিংটা বাজাচ্ছে, বললেন-
: কি হলো ফোনটা ধরছিস না কেন, বেজেই চলছে। ওটাতো আমার মাথায় হাতুড়ি পেটাচ্ছে, তোর ফোন ধরতে ইচ্ছে না করলে কেটে দেয়। ঘরে প্রবেশ করা অবধি এই অবস্থা দেখছি, বিষয়টা কী?
: বাজতে দাও না বাবা, বিরক্তির সাথে জবাব দিল জয়নব, আচ্ছা বাবা কখনো কখনো আমার ফোন রিসিভ করার ইচ্ছা নাও থাকতে পারে, আমি কলটা নেব না, তুমি এমন করছ কেন!
: ঠিক আছে মা, ফোন কল ধরার ইচ্ছে নাই, ধরবি না তো কেটে দিতে বা মোবাইল বন্ধ করে দিতে তোর অসুবিধা কোথায়?
: ধরো, ইচ্ছে করেই আমি কারো সাথে এমন করছি, কাউকে শাস্তি দিচ্ছি, বুঝুক কেমন লাগে।
: ঠিক আছে, তোর যা ভালো লাগে কর, কিন্তু ফোনটা অন্তত মিউট করে রাখ, অন্য একজনকে শাস্তি দিতে গিয়ে তোর বেচারা বাপকে কেন শুধু শুধু শাস্তি দিচ্ছিস।
আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে এই নাও সুইচ অফ করে দিলাম, এবার ঠিক আছে তো বাপজান, একটু আদুরে এবং আহ্লাদে গলায়ই বলল জয়নব। জয়নব বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্রী, আলী হোসেন ও ইসরাত ফাতেমার একমাত্র কন্যা। ইসরাত ফাতেমা বেঁচে নেই। তিনিই মেয়ের নাম রেখেছিলেন জয়নব বেগম। জয়নব জ্ঞান হওয়ার পর যেদিন শুনেছে তার নাম মায়ের দেয়া সেদিন থেকেই তার প্রথম প্রেমই তার নিজের নামের সাথে। নতুন পরিচিত কেউ তার নাম জানতে চাইলে সে খুব আনন্দ নিয়ে গর্বের সাথেই তার নাম বলে। পুরনো ধাঁচের নাম বলে কেউ কিছু বললে তার সহ্য হয় না।
নামটা যেহেতু মায়ের দেয়া, যে মা এখন এই পৃথীবিতে নেই। তাই নামটা তার কাছে মায়ের মতোই শ্রদ্ধেয় কিন্তু বিভিন্ন সময় লোকজনের বিভিন্ন টিপন্নির কারণে মাঝে মাঝে জয়নবেরও মনে হয় মা তার এমন নাম কেন রাখতে গেল? বাবাকেও একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, আচ্ছা বাবা, মা আমার জয়নব নামটাই কেন রাখল? প্রশ্নটা করেই সে বুঝতে পারল মস্তবড় একটা ভুল করে ফেলেছে, কারণ সে দেখল প্রশ্নটা করার সাথে সাথেই বাবার মুখটা কেমন জানি হয়ে গেল, সাথে সাথেই বলে উঠলÑ থাক বাবা বলতে হবে না, আমার ভুল হয়েছে। এরপর আর কোনো দিন জয়নবের নিজের নাম নিয়ে কোনো প্রশ্ন তার মনে আসেনি এবং সেদিনের পরে তার নামটা তার সবচেয়ে আপন হয়ে উঠল।
বাবার সাথে খুনসুটি করে যদিও মন কিছুটা হালকা হলো। তবুও সে পুরোপুরি স্থির হতে পারল না। আবারো চলে এলো তার প্রিয় পাখিটার কাছে। বাবার সাথে ঘুরতে একবার সিলেট গিয়ে সে এই মায়াটুনিটা পেয়েছিল আহত অবস্থায়, আদর যতেœ সুস্থ করে তুলেছিল। সেই থেকে পাখিটার প্রতি তার অসম্ভব মায়া) তাই মন খারাপ হলেই জয়নব তার আদুরে, ফুর্তিবাজ পাখিটার কাছে ছুটে আসে। ওকে দেখেই টুকটুক আনন্দে অ্যাক্রোব্যাটদের মতো ভঙ্গি করে তীক্ষè স্বরে ‘চাক চাক চাক চাক’ শব্দ করে নেচে ওঠে, আর মুহূর্তে জয়নবের মনও উচ্ছল হয় নেচে ওঠে।
রাহাত হোসেনের সাথে জয়নবের পরিচয় হলো প্রায় তিন বছর। রাহাতও একই বিভাগের ছাত্র। জয়নব থেকে দুই বছরের সিনিয়র। পরিচয়টাও বড় অদ্ভুতভাবে। রাহাত একদিন ডাসের কোনায় দাঁড়িয়ে আনমনে সিগারেট টানছিল আর ধোঁয়াটা কুণ্ডলির মতো করে আশপাশে ছাড়ছিল। এ সময়ই জয়নব পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটি ধোঁয়ার কুণ্ডলি ঠিক তার মুখের ওপর পড়ে। সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে পড়ে সে এবং এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড করে বসে। এক হাতে রাহাতের হাত থেকে ছোঁ মেরে সিগারেটটা টেনে নিয়ে অন্য হাতে রাহাতের থুতনিটা ধরে এবং একটানে অনেক খানি ধোঁয়া নিজের মুখে টেনে নিয়ে রাহাতের মুখের ওপর ছাড়ে। তারপর কাশতে কাশতে চোখ দিয়ে পানি চলে আসে। কিছুটা বমিও করে বসে। এদিকে জয়নবের এই কাণ্ড দেখে আশপাশের সবাই অবাক। স্বয়ং রাহাতও আশ্চর্য হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সেই দৌড়ে গিয়ে ডাস থেকে এক গ্লাস পানি এনে তার সামনে ধরে- পানিটা মুখে দেন। রাহাত রাগ ভুলে উল্টো সাহায্য করতে চায়। এই আপনি কি ফাজলামো করেন আমার সাথে।
না, দেখুন আপনি অসুস্থ হয়ে গেছেন। আগে নিজেকে সামলান তারপর যা বলার বলবেন।
এবার জয়নবও সচেতন হলো এবং কিছুটা আড়ষ্ট। মনে মনে চিন্তা করছে সে করেছেটা কী, এখন যদি সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটে তাহলে করবেটা কী। এদিকে তাদের দু’জনকে ঘিরে বেশ একটা ভিড় জমে যায়, যেন ভারি মজার ব্যাপার ঘটছে এখানে। একটু পরেই হয়তো আরো মজা দেখা যাবে।
কিন্তু না, সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে খুবই স্বাভাবিক এবং একটু উচ্চ স্বরে বলে ওঠে রাহাত, দেখুন, ভুলটাতো আমারই ছিল। আমি যা করেছি তার উত্তর পেয়েছি। আশা করি আপনারা যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছেন তারা এবার নিজ নিজ কাজে যাবেন জয়নবকে বললোÑ বলার বা যে শাস্তি দেয়ার দিন, আমি মেনে নেবো।
নিজেকে সামলে নিয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে শুধু বলল সরি। আমি ওভাবে রিঅ্যাক্ট না করলেও পারতাম। কিন্তু হঠাৎ ধোঁয়াটা চোখেমুখে লাগায় নিজেকে সামলাতে পারিনি সিগারেটের ধোঁয়া আমার অসহ্য লাগে।
আবারো বলছি, আমার ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত।
আজ প্রায় তিন বছর হলো দু’জনের ঘনিষ্ঠতা ক্রমেই গাঢ় হয়েছে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা বেড়েছে। নিজেরা একে অপরকে আরো ভালোভাবে জানার চেষ্টা করেছে। কখনোই কেউ কাউকে ছোট করে কিংবা আঘাত করে কথা বলেনি।
রাহাত পাস করে বেরিয়েছে দুই বছর হলো। একটি বিদেশী কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। জয়নব মাস্টার্স ফাইনালে, ইদানীং সময় পেলে রাহাত জয়নবের বাসায়ও আসে। আড্ডা মারে। কিন্তু তারা বাসায় তাদের আড্ডা মারার সময়টা এমনভাবে ঠিক করে নেয় যখন জয়নবের বাবা বাসায় থাকেন না, যদিও বিষয়টা তার বাবা জানেন কিন্তু তিনি তার মেয়ের ওপর বিশ্বাস হারান না।
রাহাত ও জয়নব ঠিক করে রেখেছিল আজ রাতে তারা কোনো রেস্তঁরায় খাবে। ঠিক সময়ই দু’জন রেস্তরাঁয় চলে আসেন। রাহাত খাবার অর্ডার দিলো তারপর জয়নবকে বলল, তোমার সাথে আজ এক বিশেষ কারণে এখানে বসেছি জয়, অনেক দিন থেকে তোমাকে একটি কথা বলব বলব কিন্তু বলতে পারছিলাম না। আজ বলব। আশা করি তুমি আমার কথা শুনবে এবং এ বিষয় চিন্তা করবে।
রাহাতের কথা শেষ হলে জয়নব অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর খুব স্পষ্ট এবং তীক্ষè স্বরে বললো- তোমার কথা পরে শুনব আগে তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, আমার নাম জয় হলো কবে থেকে রাহাত।
বলছি শুনো, মানে আমি তোমাকে- কথাটা শেষ করতে পারল না সে। চাপা কিন্তু কঠিন স্বরে বললো- আমার প্রশ্নের সোজা জবাব দাও, আমি জয় হলাম কবে থেকে। তুমি ভালো করেই জানো আমার নামটা আমার মায়ের দেয়া, আমি আমার নামের কোনো বিকৃতি বা সংক্ষিপ্ত রূপ পছন্দ করি না। কঠিনভাবে কথাগুলো বলল জয়নব।
আমার কথা শোনা, বলছিলাম কি তোমার নামটা বড়ই সেকেলে তাই ওই একটু আদরে এবং আধুনিকতার মেশাল দিয়ে জয় বললাম, ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো।
না, চেয়ারটা পিছনে ঠেলে ওঠে দাঁড়াল জয়নব, আমার নাম জয়নব বেগম এবং এটাই সত্য, আমার নামের সাথে আমার মা থাকেন। আমার নামটায় তোমার যদি এতই আপত্তি থাকে, তা হলে তুমি তোমাকে নিয়ে এবং নামের বাহার নিয়ে থাক আমাকে আশা করো না। আমি জয়নব বেগম বলেই দৃঢ় পায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা বাসায় চলে এলো জয়নব। কোনো কথা বলারই সুযোগ পেল না, শুধু বোকার মতো জয়নবের গমন পথের দিকে চেয়ে রইল।
গাড়িতে ওঠার পর থেকেই থেমে থেমে রাহাতের কল। এবং বাসায় ঢুকেও রাহাতের কলের কোনো বিরতি ছিল না।