একজন রাষ্ট্রনায়ক
রাজনীতিকরা ক্ষমতার অন্ধকার গুহায় বন্দী হয়ে শুধু ক্ষমতাপ্রসূত সুবিধার দিকে দৃষ্টি রাখেন। ক্ষমতার বৃদ্ধি-প্রবৃদ্ধিতেই খুশি হন। রাষ্ট্রনায়ক কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে সমাজে কল্যাণমুখী কর্মসূচির মাধমরূপেই দেখে থাকেন। তাই যে ক্ষেত্রে রাজনীতিক চান ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, রাষ্ট্রনায়ক চান ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রিকরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে। রাজনীতিকরা জনগণকে তাদের ক্ষমতা লাভের সোপান হিসেবে ব্যবহার করেই সন্তুষ্ট, রাষ্ট্রনায়ক কিন্তু জনগণকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার করে চান তাদের ক্ষমতাশালী করতে। রাজনীতিকরা নিজেদের স্বার্থে জাতীয় ঐক্যে ভাঙন ধরাতেও রাজি, রাষ্ট্রনায়ক কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করেন। রাজনীতিকদের কাছে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত অথবা দলীয় স্বার্থই মুখ্য। রাষ্ট্রনায়কের লক্ষ কিন্তু জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রাখা। দেশের ভেতরে অথবা বাইরে জাতীয় ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করা। শুধু রাষ্ট্রনায়কই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে, তাদের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে, বর্তমানকে ছাপিয়ে দূর ভবিষ্যতের স্বপ্নে জনগণকে সচকিত করতে সক্ষম।
এসব বিবেচনায় রেখেই বলতে চাই, আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আকাশছোঁয়া গুণপনাসমূহের। আইনানুগ সমাজ গঠনে তার একাগ্রতার, দুর্নীতির প্রতি তার তীব্র ঘৃণার, সুশাসনের প্রতি গভীর আকর্ষণের, স্বশাসনের প্রতি তার সহজাত দুর্বলতার, সমাজব্যাপী শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রচনায় তার বলিষ্ঠ পদক্ষেপের। বিশ্বায়নের একালে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মননশীলতার, সৃজনশীল চিন্তাভাবনার। উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রান্তসীমায় দণ্ডায়মান বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্যকে বিশ্বময় প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। প্রতিযোগিতার বৃহত্তর ক্ষেত্রে টিকে থাকার জন্য জনগণকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। উন্নত মানব সম্পদরূপে তাদের গড়ে তুলতে হবে। সমগ্র সমাজটাকে জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত করতে হবে। সামাজিক শক্তিগুলোকে সব অনৈক্য ও বিভেদ জয় করে বৃহত্তর ঐক্যের উপত্যকায় উপনীত হতে হবে। মেধা চর্চার মাধ্যমে সৃষ্টিশীল প্রত্যয়ের দিগন্ত বিস্তৃত করতে হবে। সমাজটাকে মুক্ত সমাজের আদলে তুলে ধরতে হবে। এসবই তো এখনকার প্রয়োজন। এসব প্রয়োজনের নিরিখেই এ সমাজের দাবি হচ্ছে জিয়াউর রহমানের ধীশক্তি। তার মেধা। তার বিশ্বাস। তার সততা। তার দূরদৃষ্টি। তার দেশপ্রেম। যখন তিনি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে বাংলাদেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন, তখনকার কথা একবার ভেবে দেখুন। ভেবে দেখুন কিভাবে মাত্র দু’বছরের মধ্যে জাতীয় জীবনের সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে অকুতোভয় এক সৈনিকের মতো, অনেকটা একক প্রচেষ্টায় দুস্থ, অসহায়, বাংলাদেশকে অনগ্রসরতার গভীর গহ্বর থেকে তুলে উপস্থাপন করলেন অগ্রগতির মহাসমুদ্রের তীরে। ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ ছিল সামরিক অভ্যুত্থান প্রতি অভ্যুত্থানের আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। ডান-বামের টানাপড়েনে নিঃস্ব প্রায়। যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দাবিতে জাতি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের আগুনে ঝলসে গেল সেই বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র নির্বাসিত। একদলীয় কর্তৃত্বব্যঞ্জক বাকশালের গুরুভারে জাতীয় জীবন ন্যুব্জ। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবয়বে অপচয়প্রবণ ও পীড়নমূলক লুটেরা অর্থনীতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের দীনহীন ও নিঃস্ব অবস্থা তথা তলাবিহীন ঝুড়ির দুর্দশা। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের নিঃসঙ্গ, একাকী, বন্ধুবিহীন, শ্রমহীন ও হতশ্রী চেহারা।
এমনি যখন বাংলাদেশের অবস্থা তখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব এলো জিয়াউর রহমানের ওপর। একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তিনি একজন পেশাদার সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে সমাজের সামগ্রিক চেহারাটা অনুধাবন করে এর সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণ করেন। তারপর এসব সমস্যা সমাধানের দিকে দৃষ্টি দেন। তিনি অনুধাবন করেন, দেশের হাজারো সমস্যার মোকাবেলার জন্য প্রথমত সরকারকে হতে হবে শক্তিশালী, ভীষণ শক্তিশালী। সরকারকে শক্তিশালী হতে হবে বিভিন্ন কারণে : এক. রাষ্ট্রের প্রধান যেসব দায়িত্ব-ভৌগোলিক অখণ্ডতা সংরক্ষণ, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব নিশ্চিন্তকরণ, দেশের অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্বাভাবিকীকরণ এবং আইনের প্রাধান্য নিশ্চিতকরণ, নাগরিকদের জীবন ও সম্পদের নিশ্চয়তা বিধান পালন করা। এ কোনো দুর্বল সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তিনি বিদ্যমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থার উন্নতি সাধনে মনোযোগী হন। আগ্রহী হন আধা-সামরিক বাহিনীর সার্বিক উন্নয়নে। আগ্রহী হন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আধুনিকীকরণে। প্রচলিত বিচারব্যবস্থার কার্যক্রমে দক্ষতা, নিরপেক্ষতা এবং সততা আনয়নে উদ্যোগী হন। দায়িত্ব নেয়ার ছয় মাসের মধ্যেই এসব ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। দুই. তিনি অনুধাবনে সক্ষম হন, সরকার শক্তিশালী না হলে জনগণের আনুগত্য লাভে তা সমর্থ হবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন, জনগণের সার্বিক সমর্থনই সরকারকে শক্তিশালী করে তোলে। তাই জনসমর্থন নিশ্চিত করতে তিনি কেন্দ্রের ওপর যতটা নির্ভর করেছেন, তার শতগুণ নির্ভর করেছেন প্রান্তের ওপর। দেশের প্রান্তসীমা পর্যন্ত তিনি ছোটাছুটি করেছেন জনগণের সাথে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য। তাদের ভাষায় কথা বলা, তাদের চিন্তা-ভাবনা আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে ছিন্ন করে জনগণের সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে। গণতান্ত্রিকব্যবস্থায় জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন অপরিহার্য দুটি কারণে। এক. রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে জনগণ যদি একবার ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয় তাহলে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হতে বাধ্য, কেননা সরাসরি জনগণের জন্য উন্নয়নমূলক কর্ম। দুই. জনগণ একবার রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশীদার হয়ে উঠলে সমাজের অগ্রহণযোগ্য অংশ মাস্তান, চাঁদাবাজ, লুণ্ঠনকারী, নিপীড়ক আইন ভঙ্গকারী নিরস্ত্র হতে বাধ্য। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ সহজ হয়ে আসে। সমাজে আইনের প্রাধান্য নিশ্চিত হয়। তাই দেখা যায়, জিয়াউর রহমান যতদিন ক্ষমতাসীন ছিলেন সেই সময়কালই এ দেশের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা শান্তির কাল বলে চিহ্নিত হয়েছে। আজকের সমাজে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির যে মচ্ছব পরিলক্ষিত হচ্ছে ওই সময়ে তার বিন্দুমাত্রেরও প্রকাশ ঘটেনি। অথচ ১৯৭২-৭৫ সময়কাল তা ছিল অনেকটা দুরারোগ্য ব্যাধির মতো। তার মৃত্যুর পরে আবারো ওই সব ব্যাধি নতুন আকারে প্রকারে প্রকাশিত হয়।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার নতুন নতুন পদক্ষেপ এ সমাজে সৃষ্টি করে সৃজনশীল এক আবহ। কৃষককে ঋণ দান করে, পানি সেচের ব্যবস্থা করে, রাসায়নিক সার প্রয়োগে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করে, উন্নত বীজের প্রয়োগ সহজলভ্য করে তিনি কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লবের সূচনা করেন। খাল খনন প্রকল্প এ ক্ষেত্রে ছিল এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। দেশের পণ্যসামগ্রী বিদেশে রফতানির মাধ্যমে, নতুন নতুন পণ্যের বাজারজাতকরণের মাধ্যমে, বেসরকারি খাতে উৎপাদনের উৎসাহ যুগিয়ে, বেসরকারি ব্যাংক-বীমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে দেশে উৎপাদনের নতুন জোয়ার সৃষ্টি করেন। ফলে বাংলাদেশ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র যে লজ্জাকর অভিধা লাভ করেছিল, তা থেকে জাতি অব্যাহতি লাভ করে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এভাবে মর্যাদার আসনে আসীন হয় বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট হয় কর্মতৎপর মধ্যপ্রাচ্যের সাথে। যুক্ত হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে। ইউরোপ এবং আমেরিকা বাংলাদেশকে নতুন আলোকে দেখতে শুরু করে। আজকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যেভাবে কলঙ্কিত হয়েছে, বছরের পর বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে জাতীয় মর্যাদা যেভাবে ধূলি ধূসরিত, প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে এমন অবস্থা ছিল কল্পনাতীত।
তাই বলি, সেই মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সবচেয়ে উত্তম প্রক্রিয়া হলো তার চিন্তাভাবনাকে ধারণ করে, তার আদর্শকে মাথায় নিয়ে, তার দক্ষতা, সততা এবং জনদরদি ভাবধারাকে পুঁজি করে তারই নির্দেশিত পথে চলা। নিজেদের কাজকর্মে তাকে আদর্শ জ্ঞান করে তাকে সামনে রাখা।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়