ঈদ হয়নি আমজাদের পরিবারের, আতঙ্ক কাটেনি শিশুদের, ‘বাবা না আসা পর্যন্ত আমি খাব না’
বদরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি : ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সাঙ্গপাঙ্গদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার রংপুরের বদরগঞ্জের অটোরিকশাচালক আমজাদ হোসেনের বাড়িতে ঈদের দিনেও চুলোয় হাঁড়ি ওঠেনি। পরিবারের লোকজন না খেয়েই দিনটি কাটিয়েছেন। আমজাদের তিন মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে আফরিন আখতার (১০) ও আঁখি আখতার (৭) বাবার জন্য দিনভর কান্নাকাটি করেছে। তাদের মন থেকে বাবাকে মারার ঘটনার পর ভয় ও আতঙ্ক কাটছে না।
তবে এখনো আমজাদ হোসেনের পক্ষে দাঁড়ায়নি প্রশাসন কিংবা কোনো মানবাধিকার সংস্থা। গত মঙ্গলবার প্রথম আলো ডটকমে ‘শিশুদের সামনে বাবাকে বেঁধে লাঠিপেটা’শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।এতে পাঠকেরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।
গতকাল বুধবার পবিত্র ঈদের দিন বিকেলে সরেজমিন আমজাদ হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর বড় মেয়ে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী আফরিন ও মা আমেনা বেগম কাঁদছেন। এ সময় আমজাদের স্ত্রী কুলসুম বেগম ও অপর দুই মেয়ে বাড়িতে ছিলেন না।
আমেনা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘বাবা, আমার ছেলে আসবে কখন। ভোটে চেয়ারম্যানের বিপক্ষে কাজ করায় তাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসিয়ে জেলে দিয়েছে। ছেলের হাত-পা বেঁধে চেয়ারম্যান আমার সামনে পিটাইছে। ও আল্লাহ, আমার মৃত্যু দাও।’
কান্নার শব্দে বাড়িতে প্রতিবেশীদের আসা শুরু হয়। কথা হয় প্রতিবেশী মহেব্বুল হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, দুলু মিয়া, মাসুদা বেগমসহ অনেকের সঙ্গেই। তাঁরা জানান, আমজাদ খুব ভালো মানুষ। তাঁর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ ভিত্তিহীন। তাঁকে ষড়যন্ত্র করে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে ও ফাঁসানো হয়েছে। এ কারণে ঈদের দিনে খুশির বদলে তাঁর পরিবারের লোকজন না খেয়ে কান্নাকাটি করে কাটিয়েছেন।
আমজাদ হোসেনের বড় মেয়ে আফরিন আখতার কেঁদে কেঁদে বলে, ‘আমার বাবাকে ওরা খুব মারছে। বাবা না আসা পর্যন্ত আমি খাব না। আমার বাবা খুব ভালো।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমজাদ হোসেনের বাবা আবদুল গফুরের নাম অনুযায়ী গ্রামের নামকরণ হয়েছে ‘গফুরের পাড়া গ্রাম’। বাবা আবদুল গফুর এখনো বেঁচে আছেন। আমজাদসহ তাঁর দুই ছেলে, চার মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। তাঁর এখনো চার একর ৫০ শতক আবাদি জমি রয়েছে। এর মধ্যে তিন একর জমি দুই ছেলেকে ভাগ করে দিয়েছেন। এক একর ৫০ শতক বসতভিটায় তিনটি টিনশেডের পাকা কক্ষ ও তিনটি গোয়ালঘর রয়েছে।
আমজাদের বাবা আবদুল গফুর বলেন, ‘আমার ছেলে চোর—এটা কালুপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল হক মানিক ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। আমজাদ খুব পরিশ্রমী ও লাজুক ছেলে। জমির কাজ না থাকলে সে চট্টগ্রামে গিয়ে অটোরিকশা চালায়। ভোটের সময় চেয়ারম্যানের বিপক্ষে কাজ করায় ছেলেটাকে চোরাই গরু রাখার অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছে।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘চেয়ারম্যান এলাকায় চোর-ডাকাত নিজে পোষেণ। নির্যাতনের ভয়ে চেয়ারম্যানের বিপক্ষে এলাকায় কেউ কথা বলেন না। এখন চেয়ারম্যান আমাদের আরও মামলা মোকদ্দমার ভয় দেখাচ্ছেন।’ তিনি চেয়ারম্যানের বিচার দাবি করেন।
বদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল হক চৌধুরী গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘আমজাদ হোসেনকে নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে পুলিশ বিভাগের ঊর্ধ্বতন মহলে কথা হচ্ছে।আমি পুরো বিষয়টি অবহিত করেছি।সবাই ঈদ নিয়ে এখন ব্যস্ত। যদি আমজাদের পরিবারের পক্ষে কেউ অভিযোগ দেয়, তাহলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
প্রসঙ্গত, বদরগঞ্জ উপজেলার বৈরামপুর গফুরেরপাড়া গ্রামের আবদুর গফুরের ছেলে আমজাদ হোসেন কোরবানির জন্য স্থানীয় কাঁচাবাড়ি মৌলভীপাড়া গ্রামের ছহিরুল ইসলামের কাছ থেকে গত শনিবার ১১ হাজার টাকায় একটি গরু কেনেন। পরদিন চেয়ারম্যান শহিদুল হক মানিকের নির্দেশে গ্রাম পুলিশের সদস্যরা গরু কেনার বৈধ কাগজপত্র (হাসিল) না পেয়ে আমজাদ হোসেন ও গরুর বিক্রেতা ছহিরুলকে আটক করেন। এরপর ওই দুজনকে চেয়ারম্যান ও গ্রাম পুলিশের সদস্যরা কোমরে দড়ি বেঁধে পেটাতে পেটাতে এলাকায় নিয়ে ঘুরে বেড়ান। পরে তাঁদের বৈরামপুর উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়।
চেয়ারম্যান উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘আমার পক্ষে যারা ভোট করেছে তারা মদাড়ু, জুয়াড়ু বা চোর নয়। আমার বিরুদ্ধে যারা ভোট খেলছে তারা ভালো মানুষ না। যাদের ধরা হয়েছে তাদের কী করা উচিত?’ এ সময় চেয়ারম্যানের লোকজন বলে ওঠেন, ‘ফাঁসি দেওয়া উচিত।’ এরপর শুরু হয় বেধড়ক পেটানো। এ সময় আমজাদের দুই অবুঝ মেয়ে বাবাকে না পেটানোর জন্য চেয়ারম্যান ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের হাতে পায়ে ধরেন। কিন্তু তাঁদের মন গলেনি। অবুঝ শিশুদের সামনেই হাত-পা বেঁধে মাটিতে ফেলে আমজাদকে পেটানো হয়। চার ঘণ্টা পেটানোর পর তাঁদের থানা পুলিশে দেওয়া হ