ইরান এবার আর একা নয়

10/05/2018 1:49 pmViews: 7

ইরান এবার আর একা নয়

 

যুক্তরাষ্ট্রের চাপে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়বেযুক্তরাষ্ট্রের চাপে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়বেআল-জাজিরার বিশ্লেষক মারওয়ান বিসরা লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সব সময় শত্রু দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধমূলক পররাষ্ট্রনীতিকে বৈধতা দেওয়ার জন্যই শত্রুর উপস্থিতি খুব দরকার। একসময় যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু ছিল কমিউনিস্টরা। কমিউনিস্টরা পরাজিত হয়েছে। এরপর আরব জাতীয়তাবাদী। আরব জাতীয়তাবাদ এখন সংকটের মধ্যে আছে। পরবর্তী সময়ে জিহাদি জঙ্গিরা। এই মুহূর্তে ইরান। ইরান কেবলই যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু নয়; আরবের রাজনীতিতে মার্কিনদের দীর্ঘদিনের মিত্র সৌদি আরব ও ইসরায়েলেরও জন্যও হুমকি।

আন্তর্জাতিক সমাজ ইরান সব শর্ত মেনে চলছে বলে মনে করলেও যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণ কী? এর প্রভাব কী হতে পারে আরবের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে? প্রথম প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে সিরীয় যুদ্ধে ধরাশায়ী হওয়ায় ইরানের সঙ্গে সংঘাত তৈরি করে হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধার করা। এ ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি প্রবলভাবে ইসরায়েল ও সৌদিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে জটিল সম্পর্কের সূচনা করতে পারে। এবং এই সুযোগে আরবের রাজনীতিতে ইরান নতুন শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।

কিছুদিন ধরেই ইউরোপের সঙ্গে মার্কিনদের সম্পর্ক ঠিক আগের মতো নেই; বিশেষ করে ব্রেক্সিটের পর। জার্মানির নেতৃত্বে এক নয়া ইউরোপের উত্থান ঘটছে। গত বছর ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য ন্যাটো জোটে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে বেশি করে অর্থ প্রদানের জন্য বলেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। প্রত্যুত্তরে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল জানিয়েছিলেন, ইউরোপ নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরাই নিশ্চিত করতে পারবে।

তথাকথিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে ইউরোপের জনসাধারণ হতাশ ও ক্লান্ত। ইউরোপের জনসাধারণের মধ্যে একটি প্রশ্ন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে; বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের দায়ভার ইউরোপ কেন বহন করবে? মিলিয়ন মিলিয়ন উদ্বাস্তুকে ইউরোপের বহন করতে হচ্ছে। সন্ত্রাসেরও শিকার হচ্ছে ইউরোপ। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে। যদিও ইউরোপের জন্য বিষয়টি সহজ হবে না; এরপরও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ধীরে হলেও নিজস্ব অবয়ব অর্জন করছে। ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিবিষয়ক উদ্ভূত ঘটনায় বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়াও রাশিয়া ও চীনও শেষ পর্যন্ত ইরানের সঙ্গে থাকতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের প্রত্যাহার করায় ইরান ও আন্তর্জাতিক সমাজের হাতে পরিষ্কারভাবে দুটি বিকল্প আছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়েই সবাই এই চুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিষয়টি এমন হলে যুক্তরাষ্ট্র একা হয়ে যেতে পারে ইরান ইস্যুতে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অবস্থানকে ব্যবহার করে ইরান তার পরমাণু কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত করবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও চীন যদি শেষ পর্যন্ত ইরানের সঙ্গে থাকে এবং এই চুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তবে এটি হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের এক কূটনৈতিক বিপর্যয়। ইতিমধ্যেই সিরিয়া বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে আছে। বাশারকে ক্ষমতা থেকে না ফেলতে পারাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের কূটনৈতিক পরাজয়। এখন ইরান বিষয়েও সফল হতে না পারলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকবে।

ইতিমধ্যেই ইরান হুমকি দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যরা চুক্তি থেকে সরে গেলে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি আরও জোরদার করবে। যুক্তরাষ্ট্র অবরোধ আরোপ করে ইরানকে চাপে রাখার চেষ্টা করবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইবে। ইরান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক দেশ। ইরানের আয়ের বড় উৎস হচ্ছে তেল ও গ্যাস রপ্তানি। ট্রাম্পের ঘোষণার পরপরই বুধবার আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ৩ শতাংশ বেড়েছে। ইরানের ওপর যদি আবারও কোনো না কোনো ভাবে আববোধ আরোপ করা যায়, তবে ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা সহজ হবে। বেকারত্ব বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্যের উচ্চগতির কারণ স্বাভাবিকভাবেই জনসাধারণের অসন্তোষ বাড়বে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদি আরব সে পথেই হাঁটছে। জন-অসন্তোষকে ব্যবহার করে ইরানের ক্ষমতার পালাবদল তারা দেখতে চায়। অস্থিতিশীল ইরান তাদের জন্য খুব দরকার। যেমনটা তারা করেছে সিরিয়া ও ইরাকে। এতে করে ইসরায়েলের জায়নবাদী নীলনকশা বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে। এবং নিশ্চিত করেই ইসরায়েল এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সৌদিসহ শেখ-শাসিত অগণতান্ত্রিক আরবকে পাশে পাবে।

কিন্তু এর অন্য দিকও রয়েছে। পাশ্চাত্যের বিশ্বাসঘাতকতাকে দেখিয়ে ইরানের কট্টরপন্থীরা আবারও সামনে চলে আসতে পারে।

অনেকেই মনে করেছিলেন, ইউরোপের দেশগুলোও চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু পরিস্থিতি সেদিকে যাচ্ছে না। বরং যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়েই ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি সোমবার ইরানের সঙ্গে আলোচনায় বসবে। ইরানের সঙ্গে ইউরোপীয়দের শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে। এই বাজার হারাতে চাইবে না ইউরোপ। ২০১৭ সালে ইউরোপ ইরানের সঙ্গে ২০ বিলিয়ন ইউরোর বাণিজ্য করেছে। প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২৭ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া ইরানের বিরুদ্ধে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। যুদ্ধেরও খুব একটা শঙ্কা নেই। সিরীয় ফ্রন্ট খোলা রেখে ইরান ফ্রন্ট খোলা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য শুধু বিপর্যয়ই ডেকে আনবে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তার ইউরোপের মিত্রদের পাশে পাবে না হয়তো। তাই সৌদি ও ইসরায়েলের ওপর নির্ভর করে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চরম বোকামি হবে। এবং ইরান নিজেই হয়তো যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না; বরং যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া ইরানের জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। চুক্তিতে অন্যদের ধরে রেখে আড়ালে ইরান পরমাণু সক্ষমতা বাড়াতে পারবে।

কার্যত এটিই এখন বাস্তবতা। কারণ, ইরানের পরমাণু সক্ষমতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি ও ইসরায়েল যতটা চিন্তিত ইউরোপ ততটা নয়। ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তেই আছে। ২০১৫ সালে চুক্তি না করে ইরানের সঙ্গে অন্তত ১০ বছর আগেই পশ্চিমাদের একটি রফায় উপনীত হওয়া উচিত ছিল। এই বিলম্বের সুযোগ নিয়ে ইরান ক্রমেই পারমাণবিক শক্তির সক্ষমতা সমৃদ্ধ করেছে। এই সুযোগে ইরান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। আর যুক্তরাষ্ট্র ক্রমেই একা হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি জেমস ম্যাটিস বলেছেন, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্রের সক্ষমতা অর্জনে বাধা দিতে যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদের সঙ্গে কাজ অব্যাহত রাখবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কি এ ক্ষেত্রে সৌদি ও ইসরায়েল ছাড়া আর কোনো মিত্র পাশে পাবে?

Leave a Reply