ইরাকে মুসলিম ধর্মীয় নেতার সাথে পোপের ঐতিহাসিক বৈঠক
ইরাকে মুসলিম ধর্মীয় নেতার সাথে পোপের ঐতিহাসিক বৈঠক
ইরাকে সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের নিরাপত্তার বিষয়ে পোপ ফ্রান্সিস শিয়া ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ধর্মীয় নেতার সাথে বৈঠক করেছেন। বৈঠকটি হয়েছে ইরাকের নাজাফ শহরে।
গত কয়েক বছরে ইরাকে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের মতো খ্রিস্টানরাও নানাভাবে সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
শিয়া মুসলিমদের ধর্মীয় নেতা গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ আলি আল-সিসতানির কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে দুই ধর্মীয় নেতা তাদের আলোচনায় শান্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
করোনা মহামারি শুরু হবার পর এটাই পোপের প্রথম বিদেশ সফর এবং এই প্রথম কোনো পোপ ইরাক সফরে গেলেন। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি এবং নিরাপত্তাজনিত বিষয় বিবেচনায় নিলে এটাকেই পোপের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সফর বলে মনে করা হচ্ছে।
ক্যাথলিক গির্জার ৮৪ বছর বয়স্ক এই ধর্মগুরু এর আগে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি অনুভব করেছেন এই সফর করা তার একটা কর্তব্য। তিনি চারদিনের ইরাক সফরে বেশ কিছু স্থান পরিদর্শন করবেন।
দুই নেতা কী নিয়ে কথা বলেছেন?
ইরাকে ২০০৩ সালের মার্কিন নেতৃত্বাধীন দখল অভিযানের পর থেকে দেশটির সংখ্যালঘু খ্রিস্টানরা ব্যাপক সহিংসতার শিকার হয়েছে। গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ আল-সিসতানি বলেছেন ‘ইরাকের আর সকল জনগণের মতো খ্রিস্টান নাগরিকদেরও শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে এবং তাদের পূর্ণ সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে জীবন কাটাতে না পারার বিষয়টাতে তিনি উদ্বিগ্ন।’
ইরাকের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে সহিংস একটা সময়ে দেশটির সবচেয়ে দুর্বল এবং সবচেয়ে নির্যাতিত সম্প্রদায়ের মানুষের পক্ষে কথা বলার জন্য পোপ ফ্রান্সিস আয়াতোল্লাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘শিয়া নেতার শান্তির বার্তা ইরাকের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের গুরুত্ব এবং সব মানুষের জীবনই যে পবিত্র ও মূল্যবান তা নিশ্চিত করেছে।’
আয়াতুল্লাহ আল-সিসতানির সাক্ষাৎ পাওয়া খুবই বিরল, তিনি মানুষজনের সাথে সচরাচর দেখা করেন না। কিন্তু পোপের সাথে তিনি প্রায় ৫০ মিনিট ধরে কথা বলেছেন এবং এ সময় দুজনের কেউই মুখে মাস্ক পরেননি।
পোপ ফ্রান্সিস প্রাচীন ‘উর’ শহর পরিদর্শন করবেন। শহরটি ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদী এই তিন ধর্মের জন্যই পবিত্র স্থান। এখানে নবী আব্রাহাম (নবী ইব্রাহীম) জন্মেছিলেন।
পোপের এই সফরে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রায় ১০ হাজার ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যকে মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া করোনাভাইরাস ছড়ানো ঠেকাতে ২৪ ঘন্টার কারফিউ জারি করা হয়েছে।
কয়েকটি শিয়া কট্টরপন্থী দল পোপের এই সফরের বিরোধিতা করেছে। তারা বলছে, পোপের এই সফর দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পশ্চিমাদের নাক গলানোর সামিল।
ব্যাপকভাবে প্রতীকী সফর
ক্যাথলিক গির্জার সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ এবং শিয়া মতাবলম্বীদের অন্যতম সবচেয়ে ক্ষমতাধর ধর্মীয় নেতা গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ আলি আল-সিসতানির মধ্যে এই বৈঠকের প্রস্তুতি চলেছে কয়েক বছর ধরে।
পোপ ফ্রান্সিস অন্য সব ধর্মের সাথে হাত মেলানোর ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। ফলে গ্র্যান্ড আয়াতোল্লার সাথে তার এই বৈঠক ইরাক সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক মুহূর্ত বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ইরাকে সশস্ত্র শিয়া গোষ্ঠীগুলোর হাতে দেশটির খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ নানাভাবে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং আয়াতুল্লাহর কণ্ঠকে সেখানে একটা সমঝোতার প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
পোপ এখন ইরাকের ‘উর’ শহরে যাচ্ছেন। যে প্রাচীন শহরে নবী আব্রাহাম (নবী ইব্রাহিম) জন্মেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। খ্রিস্টান, মুসলিম ও ইহুদী তিন সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে ‘উর’ অতি পবিত্র একটি শহর। পোপ আশা করছেন এই শহরে তার সফর তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে আপোষ ও সৌহার্দের একটা পথ প্রশস্ত করবে।
ইরাকে পোপের কর্মসূচি কী?
নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং করোনা সংক্রমণ দ্রুত বাড়ার কারণে ইরাকে পোপের কর্মসূচি এবং জনসাধারণের সাথে তার সাক্ষাতের সুযোগ খুবই সীমিত রাখা হয়েছে। পোপ ফ্রান্সিসকে ফাইজার বায়োনটেক ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ দেয়া হয়েছে এবং তার সফরসঙ্গীদেরও টিকা দেয়া হয়েছে। কিন্তু পোপকে দেখতে প্রচুর জনসমাগম হলে সেখান থেকে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়াতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
শুক্রবার পোপ ইরাকে পৌঁছানোর পর তাকে কিছুটা পা টেনে টেনে হাঁটতে দেখা যায়। মনে করা হচ্ছে, তার যে সায়াটিকার সমস্যা আছে তা হয়তো আবার বেড়েছে।
রোববার পোপ ফ্রান্সিস মসুল যাবেন। সেখানে চার্চ স্কোয়ারে তিনি আইএসের সাথে যুদ্ধে নিহতদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা অনুষ্ঠান করবেন। আইএসের সাথে ইরাকে লড়াইয়ের ফলে দেশটিতে হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন।
রোববার পরের দিকে তিনি ইরাকের উত্তরে আরবিলের এক ফুটবল স্টেডিয়ামে একটি ধর্মীয় প্রার্থনাসভা করবেন বলে কথা রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ১০ হাজার মানুষ ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।
পোপ নিকটবর্তী কারাকোশও পরিদর্শন করবেন। ২০১৭ সালে সেখানে আইএস পরাজিত হবার পর খ্রিস্টানরা আবার সেখানে ফিরে গেছে।
ইরাকে খ্রিস্টানদের অবস্থা কতটা লাজুক?
বিশ্বে খ্রিস্টানদের সবচেয়ে আদি বাসস্থান ছিল ইরাক। কিন্তু দেশটিতে গত দুই দশকে খ্রিস্টানদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই সময়ে সেখানে খ্রিস্টানদের সংখ্যা ১৪ লাখ থেকে কমে আড়াই লাখে দাঁড়িয়েছে। তারা এখন দেশটির জনসংখ্যার ১% এরও কম।
আমেরিকান নেতৃত্বাধীন অভিযান ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করার পর থেকে চলা সহিংসতা থেকে বাঁচতে অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
শুক্রবার ইরাকে পৌঁছানোর পর পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, ইরাকে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের নাগরিক হিসাবে আরো বেশি মর্যাদা ও গুরুত্ব দেয়া উচিত এবং তাদের পূর্ণ অধিকার, স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ দেয়া উচিত।