আ.লীগ আমলেই হিন্দুদের ওপর বেশি নির্যাতন হয়েছে : বিএনপি মহাসচিব
আ.লীগ আমলেই হিন্দুদের ওপর বেশি নির্যাতন হয়েছে : বিএনপি মহাসচিব

ভয়ে নয়, রাজনৈতিক শিষ্টাচারের কারণেই রোববারের কর্মসূচি বাতিল করেছিলাম দাবি করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, পরিসংখ্যান বলে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সব চেয়ে বেশি নির্যাতন, অত্যাচার, জুলুম নির্যাতন হয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে রামুর ঘটনাতেও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ জড়িত ছিল। নাসিরনগরেও তাদের উপজেলা চেয়ারম্যান সরাসরি জড়িত। পাগলাপীরের ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের নিরেপক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দুর্বৃত্তদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। অযথা কাউকে অন্যায়ভাবে নির্যাতন এবং পুলিশ হয়রানি যেন না করা হয়।
সোমবার ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্টের জেরে মুসল্লি-পুলিশ সংঘর্ষের সময় দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া ও ভাংচুর হওয়া বাড়িঘর ও মন্দির এবং সংঘর্ষের সময় গুলিতে নিহত চায়ের দোকানের কর্মচারী হাবিবুর রহমান হাবিবের বাড়ি পরিদর্শন শেষে উপস্থিত সাংবাদিক ও জনতার উদ্দেশে এ কথা বলেন তিনি।
এসময় তার সাথে ছিলেন রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু, সাবেক এমপি পরিতোষ চক্রবর্তী, মোহাম্মদ আলী, রংপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি মোজাফফর হোসেন, জেলা সভাপতি সাইফুল ইসলাম, মহানগর সেক্রেটারী শহিদুল ইসলাম মিজু, জেলা সেক্রেটারী রইচ আহম্মেদ, জেলা যুবদল সভাপতি নাজমুল আলম নাজু, মহানগর যুবদল সভাপতি মাহফুজ উন নবী ডন, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আব্দুস সালাম, জেলা যুবদলী সেক্রেটারী সামসুল হক ঝন্টু, মহানগর যুবদল সেক্রেটারী লিটন পারভেজ, সাংগঠনিক সম্পাদক জহির আলম নয়ন, জেলা ছাত্রদল সভাপতি মনিরুজ্জামান হিজবুল, মহাগর ছাত্রদল সভাপতি নুর হাসান সুমন, জেলা ছাত্রদল সেক্রেটারী শরীফ নওয়াজ জোহা, মহানগর সেক্রেটারী জাকারিয়া ইসলাম জিম প্রমুখ।
পাগলাপীরের ঘটনায় বিএনপি থেকে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত টিম আসার ঘোষণা দিয়ে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, আমরা যখন শুনি। আমাদের সরকারে যে দল আছে আওয়ামী লীগ। তারা যখন আমাদেরকে দোষারোপ করে। আমি তাদেরকে অনুরোধ করব, তারা যেন খতিয়ানগুলো খুলে দেখবেন। পরিসংখ্যানগুলো দেখবেন। সেই পরিসংখ্যানের মধ্যে দেখবেন কোন সরকারের আমলে বেশি করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন হয়েছে, সংখালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার হয়েছে। এই আমলেই তাদের ঘরবাড়ি ও সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে বেশি।
তিনি বলেন, বিএনপির ওপর এ ঘটনার জন্য দোষ চাপানো পুরোপুরি মিথ্যা, বানোয়াট ও হীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। রামুর ঘটনা শুনেছেন, দেখেছেন। ইনভেস্টেগেশন দেখেছেন। সেখানে আমাদের ইনভেস্টেগশন টিম সেখানে গিয়েছিল। কী দেখেছেন তারা সেখানে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতৃবন্দ সেখানে ওই ঘটনা ঘটিয়েছে। পাবনার ঘটনা কারা ঘটিয়েছে আপনারা জানেন। নাসিরনগরে তো প্রকাশ্যে সেখানকার যে উপজেলা চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ঘটনা ঘটেছে। কোথায় এখানে বিএনপির নেতাদের পাচ্ছেন, তারা এ ধরনের ঘটনার সাথে জড়িত।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, কোন বিএনপি নেতা যদি এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকে। তাহলে তারা ব্যক্তিগত অপরাধ করেছেন। কি›ন্ত দল বা আমাদের নেতারা এবং সত্যিকার যারা আমাদের সামনের লোক তারা কখনই এ ধরনের কাজে জড়াবে না।
রোববারের ঘটনাস্থল পরিদর্শন কর্মসূচি বাতিল নিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্যের বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমি গতকাল টিভি খুলে দেখলাম, সরকারের সেতু মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তিনি বলছেন, আমার এখানে গতকাল (রোববার) আসার কথা ছিল। আমি এখানে ভয়ে আসিনি। এটাও বলছেন, যারা এসব ঘটনায় জড়িত, তারা কিভাবে আসে? তিনি একটি বিশাল দলের সাধারণ সম্পাদক। আমি আশা করি, তিনি দায়িত্বশীল কথা বলবেন। তিনি দায়িত্বহীন কথা বলতে পারেন না। আমি গতকালই আসতাম। আসিনি কারণ, আমরা শিষ্টাচারে বিশ্বাস করি। কারণ একটা রাজনৈতিক দল যেখানে প্রোগ্রাম করবে। সেখানে উপস্থিত হয়ে আমরা বাধা সৃষ্টি করতে পারি না। এটা আমরা সব সময় এড়িয়ে চলেছি। সে কারণে আজকে আমি আবার আমাদের নেতাকর্মীদের নিয়ে আপনাদের সামনে এসেছি। তিনি বলেন, আমি পারিবারিক কারণে আমার ফ্লাইট বাতিল করে পরে ফ্লাইটে এসেছি। ফলে সেতু মন্ত্রীর সাথে আমার একই ফ্লাইটে আসা হয়নি। যাওয়ার পথে তার সাথে বিমানবন্দরে আমার কথা হয়েছে। কুশল বিনিময় হয়েছে।
হিন্দু পরিবারকে সাহায্য করেন বিএনপি মহাসচিব
সাধারণ নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এমন হামলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের এমন বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে মির্জা ফখরুল বলেন, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ অবাধ নির্বাচন চাচ্ছি আমরা। তার জন্য একটা সহায়ক সরকার চাচ্ছি। কিন্তু তারা এটা করতে চান না। তারা নির্বাচন না করেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে চান। ২০১৪ সালে যেভাবে তারা বিনা ভোটে ১৫৪ জনকে যেভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করে ক্ষমতায় গিয়েছিলেন। এখনো আছেন। তারা আরেকটা সেধরনের নির্বাচন করতে চাইছেন। সে কারণে তাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের দুঃখজনক প্রচারণা করছেন তারা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগ মিডিয়া নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছে। মানুষের কথার বলাকে নিয়ন্ত্রিথ করে রেখেছে। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণেই প্রধান বিচারপতিকে কিভাবে দেশত্যাগ করতে হলো। পদত্যাগে বাধ্য করা হলো। সেটা আপনারা সবাই জানেন।
পাগলাপীরের ঘটনার উচ্চপর্যায়ের নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত টিম গঠনের দাবি জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আমাদের দলের পক্ষ থেকে আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাদের এখানে। যে দুর্ঘটনা ঘটেছে এটা আমরা কোনোমতেই কেউ আমরা কামনা করি না।
আমাদের এই বাংলাদেশে সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে সব সময় একটা সুসম্পর্ক আছে। হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান আমরা একসাথে বাস করি। বলা হয়ে থাকে হিন্দু মুসলমান যেন একবৃন্তে দুটি ফুল। এই ঘটনা যারা ঘটেছে। তারা দুর্বৃত্ত। তারা খারাপ লোক। তারা সাধারণ মানুষের ক্ষতি করে। তারা আমাদের এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফাটল ধরাতে চায়। এই ইস্যুগুলোতে কোনো রাজনৈতিক ব্যাপার নেই। এই ইস্যুতে সমস্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর মোকাবেলা করতে হবে। এই ধরনের যারা সাম্প্রদায়িকাতা সৃষ্টি করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্যই এঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত না হতেই বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করছে। আমরা কোনো মন্তব্য করতে চাই না। এভাবে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার পর তিনি সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু পরিবারের প্রত্যেককে ১০ হাজার করে টাকা, শাড়ি লুঙ্গি বিতরণ করেন।
নিহত হাবিবের বাড়িতে ফখরুল
ঠাকুরটারীতে অনুদান বিতরণ শেষে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরটারী গ্রামের পাশে লালচাঁদপুর গ্রামে সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিতে নিহত চায়ের দোকানের কর্মচারী হাবিবুর রহমান হাবিবের বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে তার স্ত্রী মোসলেমা, পিতা আব্দুর রাজ্জাক, মা আমেনা বেগম কন্যা বৃষ্টি ও হাওয়ার সাথে কথা বলে তাদেরকে ২০ হাজার টাকা প্রদান করেন।
এদিকে হাবিবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা মাত্রই শতাধিক মহিলা বিএনপি মহাসচিবকে ঘিরে ধরে পুলিশ হয়রানি থেকে মুক্তির দাবি জানান। এসময় তিনি সবাইকে ধৈর্য ধরার আহবান জানিয়ে উপস্থিত মহিলাদের উদ্দেশে হ্যান্ডমাইকে বলেন, আজকে যারা এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি। তাদেরকে খুঁজে বের করার জন্য। তাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করছি আমরা। আপনাদের ওপরে অন্যায়ভাবে যেন কোনো হয়রানি না হয়, পুলিশি হয়রানি যেন না হয়।
সেজন্য আমরা বার বার করে প্রশাসনের কাছে বলেছি। আবারো বলছি। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের বের করতে হবে। তাদেরকে সাজা দিতে হবে। আর আপনাদের এখানে যে একজন মারা গেছে। সেজন্য আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। আমি আপনাদের অনুরোধ করবো। ধৈর্য ধরে শান্তি শৃংখলার সাথে আপনারা বাস করবেন।
তিনি বলেন, হিন্দুরা আমাদের ভাই। বৌদ্ধরা আমাদের ভাই। খৃষ্টানরা আমাদের ভাই। মুসলমানরা আমাদের ভাই। আপনারা দেখবেন এই দেশে যেন ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না হয়। সেদিকটা খেয়াল রাখবেন। যারাই করতে আসুক তাদের বাধা দেবেন। আপনারা বন্ধুরা মা বোনেরা। আপনারা ধৈর্য ধরবেন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আপনাদের সাথে আছেন। তিনি বলেছেন, এই দেশের কল্যাণের জন্য। সকল মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি আপনাদের পাশে আছেন। আপনারা ধৈর্য ধরবেন। আমরা আপনাদের সকলের সাথে আছি।
এরপরও মহিলারা তার কাছে তাদের নিরাপত্তা, পুরুষদের ঘরে থাকা এবং গ্রামে পুলিশ না প্রবেশের বিষয়টি নিশ্চিত করার দাবি জানান। তিনি চলে যাওয়ার পর রংপুর জেলা ও মহানগর নেতৃবৃন্দ উপস্থিত মানুষের কথা শোনেন।
গত ১০ নভেম্বর ধর্ম অবমাননাকর চিত্র পোস্ট করার দায়ে টিটু রায়ের গ্রেফতারের দাবিতে পাগলাপীরের সলেয়াশাহ এলাকায় মানববন্ধন উত্তর বিক্ষোভে মুসল্লি-পুলিশ সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে হাবিবুর রহমান হাবিব নামের এক ফটুপাতের চায়ের দোকানের কর্মচারী নিহত এবং বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়। এসময় দুর্বৃত্তরা ঠাকুরটারি গ্রামের ১১ টি বাড়িঘরে আগুন দেয় ও ৭টি বাড়িঘরে ভাংচুর করে।
এ ঘটনায় সদর ও গঙ্গাচড়া থানায় ৩ হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামী করে দুটি মামলা করেছে পুলিশ। এ পর্যন্ত ওই ঘটনায় স্থানীয় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের নেতা মাওলানা সিরাজুল ইসলাম, মমিনপুর ইউনিয়নের তিন ইউপি সদস্য ফজলুর রহমান, সামসুল হক ও সিরাজুল ইসলামসহ দুই শতাধিক গ্রেফতার করা হয়েছে। সোমবারও রবিউল ইসলাম নামের এক শিবির কর্মীকে এই মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে গঙ্গাচড়া থানার ওসি জিন্নাত হোসেন।
এদিকে অভিযুক্ত টিটু রায়কে গত ১৪ নভেম্বর নীলফামারীর জলঢাকার গোলনা ইউনিয়নের চিরাভাজি গ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে টিটু রায়কে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গঙ্গাচড়া থানায় গত ৬ নভেম্বর আইসিটি আইনে মামলা রেকর্ড করে পুলিশ। মামলার বাদি ঘটনাস্থলের খলেয়া ইউনিয়নের লালচাদপুর গ্রামের আব্দুস ছাত্তারের পুত্র পোল্টি ব্যবসায়ী রাজু আহম্মেদ। মামলাটি এখন ডিবি পুলিশ তদন্ত করছে।
১৫ নভেম্বর টিটুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ১৮ নভেম্বর চার দিনের রিমান্ড শেষে তাকে আদালতে হাজির করা হলে আবারও চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। সে অনুযায়ী তাকে আবারও জিজ্ঞাবাদ করা হচ্ছে। এদিকে এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার সময়সীমা রোববার শেষ হয়ে যাওয়ায় কমিটিকে আরো ৭ দিনের সময় দিয়েছে জেলা প্রশাসক।