আসছে আরেকটি উচ্চভিলাষী বাজেট
ঢাকা, ১৮ মে : আগামী ৫ জুন সংসদে উত্থাপন করা হবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট। এটি বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট। গতবারের ন্যায় এবারো উচ্চভিলাষী বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী। এবারের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা । চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি। আগামী বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৩ শতাংশ এবং মুদ্রাস্ফীতি ৭ শতাংশ ধরা হচ্ছে বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে বাজেটে থাকবে বিশাল ঘাটতি। এমন বাস্তবতায় চলতি বাজেটের বরাদ্দকৃত প্রকল্পের এক তৃতীয়াংশই অসম্পূর্ণ থাকার পরেও ‘আকাঙ্খা পূরণের’ উচ্চভিলাষী বাজেট নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ, বেসরকারি খাতের আস্থা, প্রযুক্তি খাত, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই), পদ্মা সেতু প্রকল্প, শিক্ষার মান বাড়ানো, মেট্রোরেল প্রকল্প, বুড়িগঙ্গা নদী দূষণমুক্ত করা, ডিজিটাল ভূমি জরিপ ব্যবস্থা, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতসহ অন্তত ৩০টি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে আগামী বাজেট প্রণয়ন করা হবে। কমানো হবে ভর্তুকির পরিমান। আগামী বাজেটে ২০ শতাংশ কমানো হতে পারে । চলতি অর্থবছরের ভর্তুকি ছিল ৩২ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা।
ঘোষণা করা হতে পারে জেলা বাজেট। চলতি অর্থবছরে টাঙ্গাইলে পরীক্ষামূলক জেলা বাজেট দেয়া হয়েছিল। এবার অন্তত ৭ টি জেলায় বাজেট দেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, চলিত বাজেটের ন্যায় এবারো বাজেটে থাকছে বিশাল ঘাটতি। এর পরিমান হতে পারে ৬৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা মতো। এ ঘাটতির মধ্যে ২৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা মেটানো হবে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে এবং বাকি ৪৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ঋণের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। এ অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ঋণ ও সঞ্চয় পত্র থেকে ঋণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজেটের আকার না বাড়িয়ে সরকারি ব্যয় কমানো জরুরি। কিন্তু অর্থমন্ত্রী উচ্চভিলাষী বাজেট দিলেও বাস্তবতার সঙ্গে তার মিল নেই। আকাঙ্খা থাকতে পারে, তবে তা হতে হবে বাস্তবায়নযোগ্য। বাস্তবতার সঙ্গে প্রত্যাশার মিল রেখে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আলোকে রূপকল্প ২০২১ অর্জনে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপি’র বরাদ্দ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় বাড়ানোসহ এডিপিও সমপ্রসারণের কথা ভাবা হচ্ছে। বাজেটে এডিপির সম্ভাব্য বরাদ্ধ ধরা হয়েছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের মূল এডিপি অপেক্ষা ২১ শতাংশ বেশি। থাকছে অনেক রাজনৈতিক প্রকল্পও। পদ্মা সেতু প্রকল্পে রাখা হচ্ছে ৬ হাাজার কোটি টাকার মতো । চলতি অর্থবছরে এডিপি নির্ধারিত রয়েছে ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান বলেন, বাজেট প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সংস্কার জরুরি। বাজেট পদ্ধতি ঢেলে সাজানা দরকার। মূল্য সংযোজন কর কমানোসহ বড় প্রকল্পগুলোতে বরাদ্ধ বাড়াতে হবে। তবে এডিপির বরাদ্ধ এবং বাস্তবায়নে আরো সর্তক হবার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ জাস্ট নিউজ’কে বলেন, অর্থমন্ত্রী বরাবরই আকাঙ্খার কথা বলছেন। কিন্তু বাজেট বড় হলেই চলে না, অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা মধ্যে অর্থের জোগান নিশ্চিত চ্যালেঞ্জে পড়বে। তাই সরকারকে বাজেটের আকার নিয়ে বিবেচনার পরামর্শ দেন এ অর্থনীতিবিদ।
সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্রাচার্য জাস্ট নিউজ’কে বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে উচ্চাভিলাষী বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন। কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে আর্থিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা আছে কি না বাস্তবায়নে সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ। বাজেট প্রাক্কলনে বড় ঘাটতি রয়েছে। বাজেটে প্রাক্কলিত আয়-ব্যয় কোনটাই বাস্তবায়ন হয় না। বিনিয়োগে স্থবিরতা কাটেনি। ব্যক্তি ও সম্পদ দুটো নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে। এমতাবস্থায় বিশাল বাজেট অনেকটাই ঝুঁকির ।
সিপিডির গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এডিপিতে বরাদ্দ না বাড়িয়ে দূর্বল খাতগুলোতে বরাদ্ধ বাড়ানো প্রয়োজন। না হলে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পও রাজনৈতিক বিবেচনায় চলে আসতে পারে।
এদিকে, বাজেটকে বাস্তবায়নযোগ্য করতে দেশের ব্যবসায়ী ও বিশিষ্টজনদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছে সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের কাছে বিভিন্ন প্রস্তাব রাখছে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো। অর্থমন্ত্রী নিজেও বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে বাজেট প্রণয়ন নিয়ে আলোচনা শুনছেন।
আসন্ন বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সর্বোচ্চ সীমা বাড়ানোসহ একাধিক প্রস্তাবণা দিয়েছে ডিসিসিআই। এছাড়া নীট সম্পদের পরিমান ৫ কোটি টাকার উর্ধ্বে ও ১৫ কোটি টাকার মধ্যে হলে সারচার্জ ১০ শতাংশ এবং নীট সম্পদের পরিমান ১৫কোটি টাকার উর্ধ্বে হলে ১৫ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করা, কোম্পানীর ক্ষেত্রে লভ্যাংশ থেকে অর্জিত আয়ের উপর কর হার বর্তমানে ২০ শতাংশ থেকে ১৫ তে নামিয়ে আনা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে বিদ্যমান হারে বিশেষ থোক বরাদ্দ অব্যাহত রাখার দাবি করেছে সংগঠনটি।
আসন্ন বাজেটে ৬১৭টি প্রস্তাব দিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই । এর মধ্যে ২৮৮টি আমদানি শুল্ক সংক্রান্ত, আয়কর সংক্রান্ত ১৭৫টি ও ভ্যাট সংক্রান্ত ১৫৫টি প্রস্তাবনা ও সুপারিশ রয়েছে।
এছাড়া তৈরি পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ধরনের অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি ও ইস্পাতের কাঠামোর ভবনের যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক ছাড়ের দাবি জানিয়েছে পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
বাজেটে করপোরেট কর না কমানোর সুপারিশ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এ ছাড়া ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাবও দিয়েছে সিপিডি।
আগামী ৫ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত জাতীয় সংসদে ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের বাজেট উথাপণ করবেন। পরবর্তীতে সদস্যদের আলোচনা সমালোচনা শেষে ৩০ জুন বাজেট পাস করা হবে।