আল্লাহর রেজামন্দি হাসিলের সুবর্ণ রাত শবেবরাত
প্রফেসর সিরাজ উদ্দিন আহমাদ
০২ জুন, ২০১৫
আজ পবিত্র শবেবরাত অর্থাৎ পাপমুক্তির রজনী। হাদিস শরিফে এই রাতকে বলা হয়েছে লায়লাতুন নিসফি মিন শাবান অর্থাৎ শাবান মাসের পঞ্চদশ রাতই হল শবেবরাত। শব শব্দটি ফার্সি, এর অর্থ রাত আর বরাত শব্দটি আরবি যার অর্থ দায়মুক্তি, নাজাত, পরিত্রাণ ইত্যাদি। প্রকৃত উচ্চারণ শব-ই বারাআত। কিন্তু বহুল ব্যবহারের ফলে একে শবেবরাত বলা হয়। পবিত্র কোরআনে এই রাতকে লাইলাতুল মুবারাকাহ অর্থাৎ বরকতময় রাত বলা হয়েছে। সূরা দুখানে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হা-মীম, সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ, আমি এই কোরআনকে বরকতময় রাতে (লাইলাতুল মুবারাকায়) অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরিকৃত হয় আমার নির্দেশে। নিশ্চয় আমি রাসূল প্রেরণ করে থাকি।’ (সূরা দুখান : ১-৫)। এই আয়াতে লাইলাতুল মুবারাকাহ বলতে কোন রাতকে বুঝানো হয়েছে, সেই সম্পর্কে মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরদের কেউ কেউ লাইলাতুল কদরকে বোঝানো হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। উলামায়ে কিরামের কাছে দ্বিতীয় মতটি অধিক প্রসিদ্ধ। এই মত পোষণ করেন হজরত ইকরিমা (রহ.) ও মুফাসসিরদের এক বিশাল জামাত। হজরত আশরাফ আলী থানবী (রহ.)ও এই মত সমর্থন করেন এবং বলেন যে, ‘লাইলাতুল মুবারাকাহ’ দিয়ে শবেবরাত উদ্দেশ করা হয়েছে। বিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা জারুল্লাহ জামাখশারী (রহ.) তার তাফসির গ্রন্থে শবেবরাতের ৪টি নাম উল্লেখ করেছেন। ০১। লাইলাতুল মুবারাকাহ (বরকতময় রজনী) ০২। লাইলাতুল বারাআত (নিষ্কৃতির রজনী) ০৩। লাইলাতুস সাক্কি (দায়মুক্তির রজনী) ০৪। লাইলাতুর রাহমাতি (রহমতের রজনী)।
শবেবরাতের মাস শাবান সম্পর্কে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘শাবান হচ্ছে আমার মাস আর রমজান হল আল্লাহর মাস।’ হাদিসে এসেছে, রজব মাসে চাঁদ উঠলে রাসূল (সা.) এই দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ, রজব ও শাবান মাসে আপনি আমাদের বরকত দান করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, শাবান হল আমার মাস, রজব হল আল্লাহর মাস, শাবান গুনাহ বিমোচনকারী আর রমজান পবিত্রকারী। শাবান রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী মাস। কিন্তু মানুষ এর ফজিলত সম্পর্কে উদাসীন। বান্দার সব আমল পরওয়ারদিগারে আলমের কাছে পেশ করা হয়। সুতরাং আমি চাই, আমার আমল, আমি রোজা পালন করছি এমন অবস্থায় উঠানো হোক (বায়হাকি)।
শবেবরাতের ফজিলত ও তাৎপর্য সম্পর্কে হাদিসের কিতাবগুলোয় অনেক হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে, একবার রাসূল (সা.) হজরত আয়েশাকে (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান শবেবরাতে কী কী ঘটে? তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) এ রাতে কী কী ঘটে? রাসূল (সা.) বললেন, এ বছর যত সন্তান জন্ম নেবে তা এ রাতে নির্ধারিত হয় এবং এ বছর যত মানুষ মৃত্যুবরণ করবে তাও এ রাতে নির্ধারিত হয়। এ রাতে মানুষের কর্মসমূহ উঠানো হয়। এই রাতে মানুষের রিজিকসমূহ অবতীর্ণ হয়, মিশকাত, ১১৫।
হজরত আলী (রা.) রাসূল (সা.) থেকে হাদিস বর্ণনা করেন, তিনি (সা.) ইরশাদ করেন, যখন শাবানের পঞ্চদশ রাত অর্থাৎ ১৪ তারিখ দিবাগত রাত আসে, তখন তোমরা রাতে নামাজ পড় এবং পরবর্তী দিন রোজা রাখ। কারণ ওইদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহপাক প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং তাঁর বান্দাদের ডেকে বলতে থাকেন, তোমাদের মধ্যে আছে কি কোনো ক্ষমাপ্রার্থী, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। আছে কি কোনো রিজিক প্রার্থী, আমি তাকে রিজিক বাড়িয়ে দেব, আছে কি কোনো বিপদগ্রস্ত, আমি তাকে বিপদ থেকে মুক্তি দেব। এভাবে ফজরের সময় পর্যন্ত ঘোষণা দিতে থাকেন। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা ১৫ শাবানের রাতে বান্দার প্রতি বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেন এবং মুশরিক ও পরশ্রীকাতর ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (ইবনু মাজাহ, মিশকাত)। এক হাদিসে আছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, শবেবরাতের রাতে হজরত জিব্রাইল (আ.) আমাকে এসে বললেন, আজকের রাত হচ্ছে শাবানের ১৫তম রাত। এ রাতে আল্লাহতায়ালা বনু কালব গোত্রের বকরিগুলোর লোম পরিমাণ মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেবেন (বলা হয়েছে যে, ওই গোত্রের অনেক বকরি ছিল) তবে মুশরিক, হিংসুক, আত্মীয়তার সম্পর্কছেদকারী, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, পিতামাতার অবাধ্য সন্তান এবং সব সময় মদপানে লিপ্ত মানুষের প্রতি আল্লাহ করুণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন না, অর্থাৎ তাদের ক্ষমা করবেন না। হজরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, একবার শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতে জিব্রাইল (আ.) আমার কাছে এসে বললেন, হে মুহাম্মদ (সা.) আপনি নিজের মাথা আসমানের দিকে উত্তোলন করুন। আমি মাথা উঠিয়ে আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম যে, জান্নাতের সব দরজা খোলা অবস্থায় রয়েছে। প্রথম দরজায় একজন ফেরেশতা দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছেন, যে ব্যক্তি এ রাতে রুকু করছে, তার জন্য সুসংবাদ। দ্বিতীয় দরজায় দাঁড়িয়ে একজন ফেরেশতা ঘোষণা দিচ্ছেন, যে ব্যক্তি এ রাতে সিজদা করছে, তার জন্য সুসংবাদ। তৃতীয় দরজায় একজন ফেরেশতা ঘোষণা দিচ্ছেন, যে ব্যক্তি এ রাতে দোয়া করছে, তার জন্য সুসংবাদ। চতুর্থ দরজায় একজন ফেরেশতা ঘোষণা দিচ্ছেন, যে ব্যক্তি এ রাতে জিকির করছে, তার জন্য সুসংবাদ। পঞ্চম দরজায় একজন ফেরেশতা ঘোষণা দিচ্ছেন, যে ব্যক্তি এ রাতে আল্লাহর ভয়ে কান্নাকাটি করছে, তার জন্য সুসংবাদ। ষষ্ঠ দরজায় একজন ফেরেশতা ঘোষণা দিচ্ছেন, এ রাতে সব মুসলমানের জন্য সুসংবাদ। সপ্তম দরজায় একজন ফেরেশতা ঘোষণা দিচ্ছেন, যদি কারও কিছু প্রার্থনা করার থাকে, তাহলে সে করুক, তার প্রার্থনা মঞ্জুর করা হবে এবং অষ্টম দরজায় একজন ফেরেশতা ঘোষণা দিচ্ছেন, ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনকারী কি কেউ আছে? যার আবেদন মঞ্জুর করা হবে। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, আমি তখন জিব্রাইলকে (আ.) জিজ্ঞাসা করলাম, এসব দরজা কতক্ষণ পর্যন্ত খোলা থাকবে? তিনি বললেন, রাতের প্রথম থেকে সুবেহ সাদিক পর্যন্ত। অতঃপর তিনি আরও বললেন, হে মুহাম্মদ (সা.) এ রাতে তথা ১৫ শাবানের রাতে আল্লাহতায়ালা এমন অধিক সংখ্যক বান্দাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি প্রদান করেন, যত সংখ্যক লোম বনু কালবের ছাগলের রয়েছে। বলা হয়েছে, তখন বনু কালব গোত্রের অনেক ছাগল ছিল। একটি ছাগলের মধ্যেই তো লাখো কোটি লোম রয়েছে। আর অগণিত ছাগলের মোট লোম সংখ্যা গণনা করা দুঃসাধ্য। অথচ আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা তাঁর এত সংখ্যক বান্দাকে মুক্তি দেয়ার বিষয়টি কেবল শবেবরাতের রাতের তাৎপর্যই বহন করে।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলকে (স.) বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, এমন ৪টি রাত রয়েছে, যাতে আল্লাহ সব মানুষের জন্য নেকির দরজা খুলে দেন। ওই রাত ৪টি হচ্ছে : ০১। ঈদুল ফিতরের রাত ০২। ঈদুল আজহার রাত ০৩। শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাত ও ০৪। আরাফাহর রাত। এসব রাতে আল্লাহ মানুষের বয়স, রিজিক ও হজের ব্যাপারে নির্দেশাবলী লিপিবদ্ধ করেন। অন্য এক হাদিসে এসেছে, আল্লাহর কাছে পাঁচটি রাত খুবই মহিমান্বিত। ওই পাঁচটি রাতের দোয়া আল্লাহ নিশ্চিতভাবে কবুল করেন, যেমন ০১। রজব মাসের প্রথম রাতের দোয়া, ০২। শবেবরাতের দোয়া ০৩। শবেকদরের দোয়া ০৪। ঈদুল ফিতরের রাতের দোয়া এবং ০৫। ঈদুল আজহার রাতের দোয়া।
শবেবরাতে আমাদের করণীয় : রাসূল (সা.) শবেবরাতের রাতে জান্নাতুল বাকিতে চলে যেতেন এবং মুর্দাদের জন্য দোয়া করতেন। আমাদের উচিত এ রাতে কবরস্থানে গিয়ে মৃত ব্যক্তিদের জন্য দুরুদ-ইস্তেগফার পাঠ করে দোয়া করা। এই রাতে বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করা, তসবিহ পড়া, অধিক হারে দুরুদ পড়া, সাধ্যানুযায়ী নফল নামাজ পড়া, নিজের জন্য, পরিবারের সব জীবিত ও মৃত এবং জীবিত ও মৃত মুসলমানের জন্য দোয়া করা, নিজের কৃত সগিরা-কবিরা গুনাহ মাফের জন্য খালেস অন্তরে তওবা করা। শবেবরাতের পরদিন ১৫ শাবান নফল রোজা রাখা। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যখন তোমাদের মাঝে শবেবরাত আসে তখন তোমরা রাতে নামাজ পড় এবং দিনে রোজা রাখ। উলামায়ে কিরাম বলেন, নফল রোজা কমপক্ষে পরপর একসঙ্গে দুটি রাখা উচিত। ১৫ শাবানের সঙ্গে ১৪ শাবান এবং ১৬ শাবানসহ মোট তিনটি রোজা রাখা আরও উত্তম।
শবেবরাতের রাতে যা করা উচিত নয় : শবেবরাতের ভাবগাম্ভীর্যতা ও মাহাত্ম্য বজায় রাখা অপরিহার্য। কিছুতেই আতশবাজি, পটকা ফোটানো, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা করা যাবে না। এসব কাজ ইসলাম সমর্থন করে না। উলামায়ে কিরাম বলেন, পটকাবাজি, আতশবাজি ইত্যাদি সামাজিক কুসংস্কার ও অপরাধমূলক কাজ। তাছাড়া আলোকসজ্জা করা একেবারে অপচয় ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের পরিপন্থী। এটা মনে রাখতে হবে যে, শবেবরাত কোনো উৎসব নয়, আল্লাহর রেজামন্দি হাসিলের সুবর্ণ রাত।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শবেবরাত : বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের পর থেকে এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান ঐতিহ্যগতভাবে ঈদ, শবেবরাত, শবেকদর ইত্যাদি ধর্মীয় পর্বগুলো অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে শত শত বছর ধরে পালন করে আসছে। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মীয় সম্প্রীতি, পারস্পরিক সৌহার্দ্যরে সঙ্গে শবেবরাত উৎসবের আমেজে পালন করে থাকে। শবেবরাতের সন্ধ্যা থেকেই সর্বস্তরের মানুষ ইবাদত-বন্দেগির জন্য মসজিদে সমবেত হন। পাপী-তাপী সব মুসল্লির উপস্থিতিতে এক স্বর্গীয় পরিবেশের তৈরি হয়। সারারাত মানুষ আবেগ-আপ্লুত মনে আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করে গোনাহের মার্জনা চান। শবেবরাতের রাতে সব ভেদাভেদ, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে বাংলাদেশের মানুষ এক অনির্বচনীয় মেলবন্ধন তৈরি করে। শবেবরাতের রাতে এবং পরদিন রোজা পালন করে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-অনাত্মীয়, ধনী-গরিব সবাই হালুয়া, রুটি, মিষ্টান্ন ইত্যাদি খাবার পরস্পরের বাসায় হাদিয়া হিসেবে নিয়ে যান। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদিও ইবাদতের প্রতিই অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং এ ধরনের উৎসবপূর্ণ কিছু করা বা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান বা খাবারের ব্যবস্থা করাকে সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে, কিন্তু পরস্পরের খাবার আদান-প্রদান, গরিব-মিসকিনকে খাবার দান ইত্যাদি বিষয় উৎসব আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে সহৃদয়তা ও সম্প্রীতির অনুপম উপহার হিসেবে গণ্য। তবে সঠিক নিয়মে শবেবরাত পালন করার বিকল্প নেই। কেবল আমলের মাধ্যমেই এ রাতের বরকত ও ফজিলত লাভ করা সম্ভব হতে পারে। মহান আল্লাহ এ রাতের গুরুত্ব সঠিকভাবে উপলব্ধি করে আমাদের পূর্ণ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা