আ’লীগ উন্নয়নের রাজনীতি করে, বিএনপি-জামায়াত খুনের রাজনীতি করে :ঝিনাইদহে বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী
এম. রায়হান, ঝিনাইদহ : আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগ মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত করে, আর বিএনপি-জামায়াত মানুষ খুনের রাজনীতি করে। সন্ত্রাস, দুর্নীতি আর দুঃশাসন ছাড়া বিএনপি কিছুই দিতে পারে না। আসলে বিএনপির জন্ম হলো হত্যা ও খুনের রাজনীতির মধ্য দিয়ে। মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলাই তাঁদের চরিত্র। বিএনপি ক্ষমতায় এলে জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদকে লালন-পালন করে। তাই দেশের সম্মান অক্ষুণœ রাখতে আগামী নির্বাচনে আবারও নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে জয়ী করার আহ্বান জানান তিনি। মঙ্গলবার বিকেলে ঝিনাইদহ সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
গত নির্বাচন আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করায় ঝিনাইদহবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এক সময় ঝিনাইদহ সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আমরা সেই সন্ত্রাস মুক্ত করেছি। তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় আসা মানে অত্যাচার, নির্যাতন, মানুষের অশান্তি। বিএনপি ক্ষমতায় আসা মানে লুটপাট। আবার টাকা পাচার। তাদের সন্তানরা বিদেশে টাকা পাচার করে, আবার ধরাও পড়ে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতি ক্ষেত্রে আমরা গ্রাম থেকে গ্রামে উন্নয়ন পৌঁছে দিয়েছি। আমরা গ্রামের সেবা করি, উন্নয়ন করি। আজকে কৃষকরা ১০ টাকায় ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। বিনা জামানতে বেকাররা ঋণ পান। আমরা ৯০ লাখ বেকারের চাকরির ব্যবস্থা করেছি। কর্মসংস্থানের জন্য বিনা জামানতে ১ লাখ টাকা ঋণও পান বেকাররা।
বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি সন্ত্রাসীদের লালন-পালন আর মানুষের ওপর অত্যাচার করে। তাঁদের কাছ থেকে কী আর আশা করা যায়। ইসলামের নামে বিএনপি জামায়াত মানুষকে বিভ্রান্ত করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করাই তাঁর সরকারের লক্ষ্য। হেফাজতকে উস্কে দিয়ে বেগম জিয়া কোরান শরীফের অবমাননা করেছেন। গত ৫ মে তাঁরা কোরান শরীফ পুড়িয়েছে। তিনি বলেন, কোন মুসলমান এটা করতে পারে না।
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁরা মসজিদে আগুন দিয়েছে। এদের ধর্ম-কর্ম কিছুই নেই। এমনকি বিএনপি ২১ আগস্ট আমাকেও হত্যার চেষ্টা করেছিল। আমি প্রাণে বাঁচলেও আমাদের নেত্রী আইভি রহমানসহ ২২ জন নেতাকর্মীকে তাঁরা হত্যা করেছিল। খালেদা জিয়ার ক্যাবিনেটের মন্ত্রী আর ওনার ছেলে তারেক এসবের সঙ্গে জড়িত ছিল। তিনি বলেন, যাঁরা মসজিদে আগুন দেয় তাঁরা ইসলামের হেফাজত করতে পারে না। যাঁরা কাবা শরীফের ছবি নকল করে তাঁরা কিভাবে ইসলামের হেফাজত করবে। ইসলাম শন্তির ধর্ম। ইসলাম আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। প্রযুক্তির উন্নয়নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ’৯৬ সালে সরকারে এসে আমরা আপনাদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিয়েছিলাম। আজ সবার হাতেই মোবাইল ফোন। প্রযুক্তি আজ ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছি আমরা। আওয়ামী লীগকে আপনারা ভোট দিয়েছেন। আমরা আপনাদের সেবা করেছি। হাতে হাতে ল্যাপটপ তুলে দিয়েছি। মানুষের দোর গোড়ায় ই-সেবা পৌঁছে দিয়েছি। জনসভায় প্রধানমন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় এলে আবারও দেশে জঙ্গীবাদ কায়েম হবে।
এর আগে একই মাঠে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ১২টি প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন ও ৩টি প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ঝিনাইদহ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন, ঝিনাইদহ সরকারী ভেটেরিনারি কলেজ, ঝিনাইদহ মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি, মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ওরাল স্যালাইন ফ্যাক্টরি, শিশু একাডেমী কমপ্লেক্স, সরকারী কেসি কলেজের নবনির্মিত চারতলা ভবন, ঝিনাইদহ পৌরসভার সম্প্রসারিত ভবন ও পোস্ট অফিস ভবন উদ্বোধন করেন। এ সময় তিনি ঝিনাইদহ সরকারী কেসি কলেজের নতুন একাডেমীক ভবন, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শৈলকূপা বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল কলেজ ও ঝিনাইদহ ১০০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
সর্বশেষ ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঝিনাইদহে এসেছিলেন নির্বাচনী জনসভায় অংশ নিতে। সেই নির্বাচনে ঝিনাইদহের ৪টি সংসদীয় আসনের সবটিতেই জয় পান আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। প্রায় ৫ বছর পর যখন তিনি আবারও এলেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এই জেলায় তখন সামনে আবারও জাতীয় নির্বাচন। তাই গত নির্বাচনের মতো এবারও আওয়ামী লীগের পাশে থাকতে এখানকার মানুষদের আহ্বান জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশাল জনসভায় দাঁড়িয়ে দেশের শান্তি, উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বিকেল ৪টায় বক্তৃতা শুরু করেন এবং ২৫ মিনিট বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে হেলিকপ্টারযোগে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ মাঠে হেলিপ্যাডে অবতরণ করেন। দুপুর ২টা ৩৮ মিনিটে তিনি চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন গোলচত্বরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ‘প্রেরণা ’৭১-এর শুভ উদ্বোধন করেন। এর পর তিনি সার্কিট হাউজে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে তিনি সরকারী বালক বিদ্যালয় মাঠে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভামঞ্চে উপস্থিত হন। বিশাল জনসভামঞ্চে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা হাত নেড়ে নেড়ে শুভেচ্ছা জানান লাখো জনতাকে। সে সময় চারদিক থেকে ‘জয় বাংলা, শেখ হাসিনা এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সঙ্গে’ সেøাগানে সেøাগানে প্রকম্পিত করে তোলে সারা এলাকা।
প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় সকাল থেকেই মানুষ আসা শুরু হয়। দুপুর হতে না হতেই শহর, ইউনিয়ন, গ্রামসহ বিভিন্ন পাড়া মহল্লা থেকে মিছিলের পর মিছিল আসতে শুরু করে জনসভাস্থলে। তাঁরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবি সংবলিত রং-বেরং-এর ব্যানার ফেস্টুন প্লাকার্ড নিয়ে আসতে থাকে জনসভায়। মিছিলে মিছিলে মুখরিত হয়ে উঠে ঝিনাইদহ শহর। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেড়লাখ মানুষের ধারণ ক্ষমতার সরকারী বালক বিদ্যালয় মাঠ কানাই-কানাই পূর্ণ হয়ে যায়। তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না কোথাও। দূর-দূরান্ত থেকে আসা হাজার হাজার মানুষ গণতন্ত্রের মানষকন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য কেউ ঘরের ছাদে আবার কেউ গাছের ডালে উঠে বসে। ঢাক-ঢোল বাজাতে বাজাতে মিছিল নিয়ে উপস্থিত হয় অনেকে। দীর্ঘ ৫ বছর পর প্রিয় নেত্রীকে কাছে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে ঝিনাইদহবাসী। জনসভাস্থল থেকে ঝিনাইদহ-যশোর সড়ক, ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া সড়ক, ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা সড়ক বন্ধ হয়ে যায় মানুষের ভিড়ে। হাজার হাজার মানুষ গাড়ি করে এসেও উপস্থিত হতে পারেনি জনসভা ময়দানে। তাঁদের কেউ কেউ ২ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে গাড়ি রেখে পায়ে হেটে জনসভাস্থলে উপস্থিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে কঠোর নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয় ঝিনাইদহ শহরকে। র্যাব, পুলিশ, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সসহ (এসএসএফ) বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় নিরাপত্তা জোরদারে।
বিশাল এ জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ প্রতিমন্ত্রী আব্দুল হাই এমপি। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক এমপি, শফিকুল ইসলাম অপু এমপি, আব্দুল মান্নান এমপি, শফিকুল আজম খান চঞ্চল এমপি, নুরজাহান বেগম এমপি, ঝিনাইদহ পৌরসভা মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু, ঝিনাইদহ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাহমুদুল ইসলাম ফোটন, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান কনক কান্তি দাস, ভাইস চেয়ারম্যান জেএম রশিদুল আলম রশীদ, কালীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ারুল আজিম আনার, মহেশপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মইজুদ্দিন হামিদ, আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট আব্দুর রশিদ, জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার মকবুল হোসেন, তৈয়ব আলী জোয়ারদার, গোলাম সরোয়ার সউদ, আক্কাছ আলী, জীবন কুমার বিশ্বাস, অশোক ধর, পঙ্কজ শাহা, রেজাউল করিম টিটোন, কাজী নসিম আল মামুন রুপক, মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক, সোনা সিকদার, মশিউর রহমান জোয়ারদার, নাসের আলম সিদ্দিকী উজ্জল, একরামুল হক লিকু, সরোয়ার জাহান বাদশা, খায়রুল ইসলাম প্রমুখ। বিশাল এ জনসভাটি পরিচালনা করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান।
এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী ছিলেন, শেখ হেলাল উদ্দিন এমপি, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সহকারী সাইফুজ্জামান শেখর। যশোর, মেহেরপুর, মাগুরার, চুয়ডাঙ্গার সংসদ সদস্যসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ।
জনসভায় কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, কৃষিতে সবচেয়ে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। দেশের কৃষকরা এখন ভাল আছে। তাঁরা অত্যন্ত কমমূল্যে সার, কীটনাশক ও বীজ পাচ্ছেন। একমাত্র শেখ হাসিনার সরকারই মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য ভাতাদি বাড়িয়েছেন। তিনি আগামী নির্বাচনে আবারও আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করার আহবান জানান।
জনসভায় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছেন, মহাজোট সরকার দেশে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। সন্ত্রাস কবলিত ঝিনাইদহের মানুষ আজ শান্তি ঘুমাতে পারছেন। যা আগে পারেনি।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেছেন, চোরের মায়ের বড় গলা। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগকে ডাকাত সরকার বলেছেন। দেশে সবচেয়ে বড় ধরনের সন্ত্রাস, দুর্নীতি করেছে। তাঁরা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। তিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সম্পর্কে দেশবাসীকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে আগামী নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে আবারও জয়যুক্ত করার আহ্বান জানান।