আনোয়ারকে বিদায় করতে গিয়ে নিজেই বিদায় মাহাথির

01/03/2020 1:05 pmViews: 4

আনোয়ারকে বিদায় করতে গিয়ে নিজেই বিদায় মাহাথির

আনোয়ারকে বিদায় করতে গিয়ে নিজেই বিদায় মাহাথির – সংগৃহীত

তিনি চেয়েছিলেন আনোয়ার ইব্রাহিমকে বিদায় করে দিতে, কিন্তু শেষে দেখা গেল, তিনি নিজেই বিদায় নিয়েছেন। হয়তো এটিই তার জীবনের শেষ খেলা এবং তাতে তিনি হেরে গেছেন।

মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বেশি দিন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। আবার আনোয়ার ইব্রাহিমকে বাদ দিতে দেশটির সবচেয়ে পদত্যাগ করার মধ্যেও আরেকটি রেকর্ড গড়েছিলেন। তা হলো সবচেয়ে কম সময়ের প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দক্ষতার পরিচয়ই দিয়েছিলেন।

নানা খেলায় তিনি জয়ীই হয়েছেন।। এমনকি ২০১৮ সালে অবসর থেকে বের হয়ে ক্ষমতাসীন দলকে পরাজিত করেও চমক সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু সেই তিনিই শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে হেরে গেলেন। দুই বছর আগে ক্ষমতায় এসেছিলেন আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু ওই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ক্ষমতায় থেকে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, আনোয়ার ইব্রাহিমকে বাদ দিতে গিয়ে নিজেই ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গেছেন। আনোয়ার ইব্রাহিমও ক্ষমতায় আসতে পারেননি, কিন্তু মাহাথিরের স্বপ্নও পূরণ হয়নি। মাঝ খান দিয়ে যে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিলেন মাহাথির-আনোয়ার, তারাই ক্ষমতায় ফিরে এলো।

মুহিউদ্দিন ইয়াসিন দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রোববার শপথ গ্রহণ করবেন। তিনি কিন্তু ঠিকই ঝোপ বুঝে কোপ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদটি বাগিয়ে নিলেন। আনোয়ার ইব্রাহিম চেষ্টা করেছিলেন মাহাথিরকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে দিয়ে তাদের আশার জোটটি টিকিয়ে রাখতে। মাহাথির মোহাম্মদও মনে করেছিলেন, তিনি কোনো না কোনো হিসাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি যে অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে তাতে নিজেকেও পড়তে হতে পারে। যখন তিনি বুঝেছেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর বাজি জীবন তাকে কি বিবেকের দংশনেই যন্ত্রণাতেই কাটতে হবে? সেটিই দেখার বিষয়। ২০১৮ সালে জোট গঠনের সময় বলেছিলেন, আগেরবার ক্ষমতায় থাকার সময় আনোয়ার ইব্রাহিমের ওপর তিনি অবিচার করেছিলেন। এর অবসান তিনি করতে চান। কিন্তু তিনি সম্ভবত ভুলটি আবারো করলেন।

মালয়েশিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন মুহিউদ্দিন ইয়াসিন
সপ্তাহব্যাপী অনেক নাটকীয়তার পর অবশেষে মালয়েশিয়ার প্রভাবশালী নেতা মুহিউদ্দিন ইয়াসিনকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন দেশটির রাজা সুলতান আবদুল্লাহ সুলতান আহমদ শাহ। আজ রোববার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায় তিনি দেশটির অষ্টম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা ও নামের তালিকা সংগ্রহের পর মাহাথির মোহাম্মদের দল বারসাতু’র প্রেসিডেন্ট ও সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ৭২ বছর বয়সী মুহিউদ্দিনকেই পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিলেন রাজা।

গতকাল শনিবার রাজকীয় দফতরের এক ঘোষণায় জানানো হয়, নতুন প্রধানমন্ত্রী রোববার সকালে শপথ নেবেন। আগামী ৯ মার্চ মুহিউদ্দিনকে পার্লামেন্টে এমপিদের আস্থা অর্জন করতে হবে। এ দিকে এর আগে পাকাতান হারাপান জোটের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ডা: মাহাথির মোহাম্মদের পক্ষে ২২২ আসনের সংসদের ১১৪ জন এমপির সমর্থন রয়েছে বলে দাবি করেছেন জোটের একজন মুখপাত্র। খবর মালয়েশিয়াকিনি, মালয় মেইল, ফ্রি মালয়েশিয়া টুডে, স্টার অনলাইনের।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করেন দেশটির ২৪ বছরের প্রধানমন্ত্রী ডা: মাহাথির মোহাম্মদ। ওই সময় তিনি ক্ষমতাসীন জোট ভেঙে নতুন এক কোয়ালিশন সরকার গঠন প্রক্রিয়ার ঘোষণা দেন। এ লক্ষ্যে তিনি রাজার সাথে বৈঠকও করেন। তবে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ও মন্ত্রিসভা গঠনের আগ পর্যন্ত তাকে অন্তর্র্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা জারি করেন দেশটির রাজা।

বৃহস্পতিবার মাহাথির এক ঘোষণায় জানান, যথেষ্ট সমর্থন পেলে আবারো প্রধানমন্ত্রী পদে ফিরতে রাজি আছেন তিনি। পাকাতান হারাপান জোটের নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম নিজের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবি প্রত্যাহার করে জোটের পক্ষ থেকে ডা: মাহাথির প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে ঘোষণা করেন। এর আগে বারাসাতু, উমনু ও পাস মহিউদ্দিন ইয়াসিনের পক্ষে তাদের সমর্থন ঘোষণা করে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী দাবিদার দুইজন হন বারাসাতু চেয়ারম্যান ডা: মাহাথির আর প্রেসিডেন্ট মুহিউদ্দিন ইয়াসিন। পদত্যাগ করার কারণে মাহাথির বারাসাতুতে আর নেই বলে উল্লেখ করে নিজেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন মুহিউদ্দিন। দলের সেক্রেটারি জেনারেল জানান, মাহাথির চেয়ারম্যান পদে বহাল আছেন। এই নিয়ে ক্ষণে ক্ষণে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। জোটের নেতারা দফায় দফায় রাজার সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের মতের কথা জানান। রাজার পক্ষ থেকে ঘোষণার আগ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল।

গতকাল রাজপ্রাসাদের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, পার্লামেন্টের আইনপ্রণেতাদের সাথে রাজার বৈঠকের পর দেখা গেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপি মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের নেতৃত্ব মেনে নিতে সম্মত আছেন। সে কারণেই সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে মুহিউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করা হয়েছে। এর আগে মাহাথিরের পদত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রী বাছাইয়ে পার্লামেন্টের ২২২ এমপির সাক্ষাৎকার নেন রাজা। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাদের পছন্দের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয় ওই সাক্ষাৎকারে। এর ভিত্তিতেই দুই দশক ধরে ক্ষমতার লড়াইয়ে মুখোমুখি থাকা মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিমকে পাশ কাটিয়ে ইয়াসিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাছাই করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ২০১৮ সালে গঠিত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মুহিউদ্দিন ইয়াসিন। এর আগে বারিসান ন্যাশনাল সরকারের সময় তিনি উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন। নাজিবের সাথে বিরোধের কারণে তিনি ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েন। পরে মাহাথিরের সাথে নতুন দল বারাসাতু গঠন করেন। প্রধানমন্ত্রী পদে তাকে প্রার্থী করতে সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের দল পিকেআরের বহিষ্কৃত উপপ্রধান আজমিনের নেতৃত্বে ১০ জন এমপি সমর্থন দেন।

দেশটিতে রাজার পদটি আলঙ্কারিক। যিনি বেশির ভাগ আইনপ্রণেতার সমর্থন নিয়ে রাজার কাছে হাজির হবেন; তিনি তাকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। নির্বাচন ছাড়াই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকারের স্থলে নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে তা মেনে নেয়া হবে না, আগেই ক্ষোভ জানিয়েছে মালয়েশিয়ার নাগরিক সমাজ।

নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতেই মাহাথির আচমকা পদত্যাগ করেন বলে জল্পনা-কল্পনা চলছিল দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে। তার পদত্যাগের পর ৭৩ বছর বয়সী আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে তার দলের জোটে ভাঙন ধরে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সেই ফাটল জোড়া লাগানোর চেষ্টাও হয়। রাজার ঘোষণায় মাহাথির অথবা আনোয়ার কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে না পারলেও আস্থা ভোট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে মালয়েশিয়ার পরবর্তী সরকার কোন পক্ষের হবে তা নিশ্চিত হতে। আস্থা ভোটে মুহিউদ্দিনের জেতার অর্থ হবে মালয়ভিত্তিক দলগুলোই কেবল সরকারের অংশ হবে। পাকাতান হারাপানে মালয়- অমালয় সব দলের প্রতিনিধিত্ব ছিল। দেশটির ৬০ শতাংশ মালয়, ২৭ শতাংশ চীনা এবং ৮ শতাংশ ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাগরিক রয়েছে। দেশটির অর্থনীতিতে চীনা আর রাজনীতিতে মালয়দের প্রভাব বেশি।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের নির্বাচনে নাজিব রাজাককে হারিয়ে এই জোট বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। মাহাথির মোহাম্মদ পদত্যাগ করলে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল আনোয়ার ইব্রাহিমের। কিন্তু মাহাথির সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গেলে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার সূত্রপাত ঘটে।

Leave a Reply