আদালত অবমাননা আইন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা
সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, কিছু সরকারী কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে যা বৈষম্যমূলক ॥ হাইকোর্ট
স্টাফ রিপোর্টার ॥ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। বৃহস্পতিবার বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
রায় ঘোষণার সময় আদালত বলেন, এ আইনে কিছু সরকারী কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে যা বৈষম্যমূলক। এ আইনে আদালতের ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়েছে। যা সংবিধানের ২৭, ১০৮ ও ১১২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। তাই এ আইনটি অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হলো। আদালত বলেন, সংবাদমাধ্যম একটি বড় শক্তি। আমরা প্রতিদিনই প্রেসের সাহায্য নিই। আমরা প্রেসকে লিমিট করতে চাই না। তবে নিজেদের একটা লিমিট থাকা উচিত।
এ আইনের আটটি ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করা হলেও আদালত শুনানি শেষে পুরো আইনটিকে বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করেছেন বলে জানিয়েছেন রিট আবেদনকারীর আইনজীবী এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ও সংশ্লিষ্ট আদালতে ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিত রায়।
এদিকে রায়ের পরে এ্যাটর্নি জেনারেল এ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বলেছেন, এ আইনটি প্রণয়ন করেছে সরকার। আমাদের পক্ষ থেকে আইনটিকে রক্ষার জন্য সর্বাত্মক বক্তব্য আদালতে পেশ করা হয়েছে। তবে আদালত যেটি মনে করেছেন সেভাবে রায় দিয়েছেন। এ রায়ের ফলে ১৯২৬ সালে প্রণীত আদালত অবমাননা আইনটি পুনর্বহাল হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি না দেখে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে আপীল দায়েরের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা সরকারের পরবর্তী নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি।
উল্লেখ্য, এ আইনের ৮টি ধারা নিয়ে গত ৩ এপ্রিল রুল জারি করেছিলেন একই বেঞ্চ। বুধবার রুলের চূড়ান্ত শুনানি নেয়া হয়। ৩ এপ্রিলের জারি করা রুলে হাইকোর্ট আদালত অবমাননা আইনের (সংশোধনী-২০১৩) ৮টি ধারা কেন সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়েছিলেন। ধারা ৮টি হচ্ছে- ৪, ৫, ৬, ৭, ৯, ১০, ১১ ও ১৩(২) নম্বর। এতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব এবং আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বিবাদী করা হয়। ১০ দিনের মধ্যে তাদের এ রুলের জবাব দিতে বলেছিলেন আদালত।
আদালতে রিট আবেদনটি দায়ের করেন এ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী ও এ্যাডভোকেট আয়েশা খাতুন। এই আবেদনের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।
পরে এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, সংশোধনীর মাধ্যমে আদালত অবমাননা আইনে নতুন কিছু ধারা সংযোজন করা হয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদকে অকার্যকর করা হয়েছে। আইনের ৪, ৫, ৬, ৭, ৯, ১০, ১১ ও ১৩(২) নম্বর- এ ৮টি ধারা উল্লেখ করে রিট আবেদনটি দায়ের করা হয়।
ধারাগুলো উল্লেখ করে এ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, এসব ধারায় বলা হয়েছে- কোন সরকারী কর্মকর্তা অবসর গ্রহণ করলে তাঁর বিরুদ্ধে থাকা মামলারও অবসান ঘটবে, আদালত অবমাননা মামলার শুরুতেই সরকারী কর্মকর্তাদের আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেয়া যাবে না, আপীল পর্যায়ে আদালত অবমাননায় অভিযুক্ত সরকারী কর্মকর্তা ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারবেন, নির্দোষ প্রকাশনা আদালত অবমাননা নয় এবং বিচারকদের খাস কামরায় অনুষ্ঠিত বিচারিক প্রক্রিয়ার তথ্য প্রকাশ আদালত অবমাননা নয়। এসব ধারা সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে আদালত অবমাননা আইন সংশোধন করে সরকার। এর চতুর্থ ধারায় বলা হয়, নির্দোষ প্রকাশনা বা বিতরণ অবমাননা নয়। পঞ্চম ধারায় বলা হয়, আদালতের বিচারিক কার্যধারা বা তাঁর অংশ বিশেষ নিয়ে অথবা শুনানি শেষে আদালত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এমন কোন মামলার গুণাগুণ সম্পর্কে ‘পক্ষপাতহীন ও বস্তুনিষ্ঠ’ সংবাদ প্রকাশ করলে তা অদালত অবমাননা হিসেবে গণ্য হবে না।
ষষ্ঠ ও সপ্তম ধারায় বলা হয়, কোন ব্যক্তি অধস্তন আদালতের বিচারক সম্পর্কে ‘সরল বিশ্বাসে’ কোন বিবৃতি বা মন্তব্য করলে অথবা আদালতের খাস কামরায় বা রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠিত বিচারিক কার্যধারা সম্পর্কে পক্ষপাতহীন ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রকাশ করলে তাও আদালত অবমাননা হিসেবে গণ্য হবে না। নবম ধারায় বলা হয়, এ আইনের অধীন শাস্তিযোগ্য নয় এমন প্রকাশনা বা কাজ এ আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য হবে না।
১০, ১১ ও ১৩ (২) ধারায় সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমানানা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, কোন কর্মকর্তা রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন, বিধিমালা, সরকারী নীতিমালা অনুসরণ করে কোন পরিপত্র, প্রজ্ঞাপন বা স্মারক জারি করলে বা এবং আদালতের কোন রায়, আদেশ বা নির্দেশ ‘যথাযথ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও’ বাস্তবায়ন বা প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ তোলা যাবে না। কোন সরকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা হলে তিনি সরকারী খরচে আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন, তবে দোষী সাব্যস্ত হলে ওই টাকা তাকে ফেরত দিতে হবে। আদালত অবমাননার মামলায় জড়িত কোন সরকারী কর্মকর্তা অপসারিত হলে বা অবসরে গেলে আদালত তাকে অবমাননার দায় থেকে অব্যাহতি দিতে পারবে। এ ছাড়া আদালত অবমাননার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত কেউ আপীলে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলে আদালত তাঁর দ- মওকুফ বা হ্রাস করতে পারবে।