আদালতের স্থগিতাদেশ থাকলেও রেলওয়েতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
রেলওয়েতে ট্রেনের পরিচালক (গার্ড) পদে নিয়োগে আদালতের স্থগিতাদেশ থাকলেও তা অমান্য করে রেল কর্তৃপক্ষ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এমনকি অবসরে গিয়ে চুক্তিভিত্তিক সাত-আট বছর গার্ড পদে চাকরি করার পর আবার তাদের উচ্চ বেতনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। অথচ গার্ড পদে নিয়োগের জন্য রেলওয়ের ১৭১ জন কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে রাখা হয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়েতে কর্মরত থাকাবস্থায় পরিচালক (গার্ড) পদে পদোন্নতির জন্য ২০১৯ সালে দুই মাসের প্রশিক্ষণ নেন ৬১ কর্মী। চট্টগ্রামে রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে সনদও দেয়া হয় তাদের। এ সময় বলা হয়েছিল সরাসরি গার্ড হিসেবে তারা যোগ দেবেন। কিন্তু এখনো ‘গার্ড’ পদে কাজের সুযোগ হয়নি গার্ডশিপ প্রশিক্ষণ নেয়া অনেক কর্মীর।
নিয়োগ না পেয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া ৩৭ জন কর্মী আদালতের আশ্রয় নিলে ঢাকার প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল-১ মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত গার্ড পদে লোক নিয়োগে স্থগিতাদেশ দেয়। কিন্তু এর মধ্যে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পত্রিকায় সংশোধনী বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গার্ড নিয়োগ করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিষয়টি নিয়ে রেলমন্ত্রী, রেলের মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। একাধিকবার চেষ্টা করলেও সাড়া মেলেনি তাদের।
প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলায় রেলের গার্ড পদে পদোন্নতি প্রত্যাশীদের আইনজীবী সৈয়দ আব্দুল্লাহ নাইম ঢাকা টাইমসকে বলেন, গার্ড হিসেবে কাজ করার জন্য কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় প্রশিক্ষণ নিলেও দায়িত্ব না পেয়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে গত বছরের ৮ মার্চ মামলা করেন রেলের ৩৭ জন কর্মী। তাদের প্রশিক্ষণ ও ১৯৮৫ সালের সার্ভিস রুল অনুযায়ী গার্ড পদে পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ থাকলেও তাদের বাদ দিয়ে অবসরে গেছেন এমন ব্যক্তিদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ নেই এমন লোকদেরও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে- এ রকম তথ্যও আদালতকে দেয়া হয়েছে। সবশেষ গার্ড নিয়োগ চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে স্থগিতাদেশ দেয়া হয়।
অন্যদিকে মামলার বাদীদের পদ সংরক্ষণ করে বাকি নিয়োগ দিতে আদালতের নির্দেশনা রয়েছে জানিয়ে আইনজীবী সৈয়দ আব্দুল্লাহ নাইম বলেন, ‘রেলওয়ের আইনজীবীকে বারবার সময় দেয়ার পরও স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দিতে না পারায় আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছে।’
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে ট্রেনে পরিচালক (গার্ড) পদে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের নিয়োগ না দিয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়ায় প্রতি বছর রেলের অনেক টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। অথচ প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হলে খরচ অনেক কমে আসবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রতিবাদ জানিয়ে নানা কর্মসূচিও পালন করা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে সংগঠনটির সভাপতি মো. মনিরুজ্জামান মনির স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে গার্ড পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ না দিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১৭১ জনকে নিয়োগের দাবি জানানো হয়।
তাদের দাবি, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত একজন ট্রেন পরিচালককে (গার্ড) প্রতি মাসে ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা বেতন দিতে হয়। সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের ট্রেন পরিচালক (গার্ড) পদে নিয়োগ দেওয়া হলে তারা প্রতি মাসে ৪২ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকা বেতন পাবেন। এতে খরচ অর্ধেকে নেমে আসবে।
জানা গেছে, রেলওয়ে ট্রেন পরিচালক (গার্ড) পদে সংকট থাকার পরও অদৃশ্য কারণে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১৭১ জনকে পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।
ট্রেন পরিচালক (গার্ড) পদে পদোন্নতির জন্য সারাদেশ থেকে ২০১৯ সালে ৬১ জনকে, ২০২১ সালে ৮১ জনকে এবং আগে আরও ২৯ জনসহ মোট ১৭১ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এমনকি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনেকের মেডিকেল পরীক্ষাও সম্পন্ন হয়েছে।
২০১৯ সালে প্রশিক্ষণ নেয়া রেলের একজন কর্মী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘গার্ডশিপ টেনিং নেয়ার পর সরাসরি গার্ড পদে আমাদের নেয়া হবে এমনটা বলা হয়েছিল। কিন্তু তখনকার রেলের এডিজি অপারেশন মিয়া জাহানের উদ্যোগে চুক্তিভিত্তিক গার্ড নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা শুরু হলে আমরা প্রতিবাদ করি। টাকার বিনিময়ে তখন ৪৭ জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়, যাদের মেয়াদ চলতি বছরের জানুয়ারিতে শেষ হয়েছে। এখন আবার তাদের নিয়োগের চেষ্টা করা হচ্ছে।’
যদিও এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মিয়া জাহান। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘কে কী বলল আর অভিযোগ দিল সেটা বড় বিষয় না। তখন নিয়োগ বন্ধ থাকায় লোকবল সংকটের কারণে একাধিক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যারা প্রশিক্ষণ নিয়ে গার্ড হওয়ার কথা বলছেন, তাদের তথ্য জানায় ভুল আছে। বিধিমালা অনুযায়ী তাদের এই পদে আসার সুযোগ ছিল না। আর নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে এডিজি অপারেশনের কতটুকু ক্ষমতা, তাও জানা উচিত।’
রেলের কর্মীদের মধ্য থেকে গার্ড (গ্রেড ২) নিয়োগের বিষয়ে ১৯৯৮ সালে জারি করা আদেশের কপি ঢাকা টাইমসের হাতে এসেছে। রেলওয়ের মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে ১৯৯৮ সালের ২৯ জুন জারি করা আদেশে নতুন নিয়োগ বন্ধ থাকায় উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকের প্রস্তাব অনুযায়ী উভয় অঞ্চলে গার্ডের শূন্যপদের ৫০ ভাগ পূরণ করা যাবে। এতে রেল কর্মচারী বিধি/৮৫ অনুযায়ী এবং নিয়োগ বিধি/৮৫ জারির আগে যেসব ক্যাটাগরি থেকে এই পদ পূরণ করা হতো সেসব ক্যাটাগরি থেকে এই পদ পূরণ করা যাবে বলা হয়।
এ ক্ষেত্রে বয়সসীমা ৪৫ বছর ও শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করা হয়। একই সঙ্গে রেলওয়ে প্রশিক্ষণ একাডেমি থেকে গার্ড (গ্রেড ২) প্রশিক্ষণ নেয়া কর্মীদের মধ্যে উত্তীর্ণদের পদায়নের কথা উল্লেখ রয়েছে ওই চিঠিতে। গার্ড পদে পদোন্নতি পাওয়ার চেষ্টায় যখন রেলের কর্মীরা আদালতে ছুটছেন, তখন ২৬ ফেব্রুয়ারি ৫৩ জন জনবল চেয়ে পত্রিকায় সার্কুলার দেয় রেলওয়ে মন্ত্রণালয়। পরে গত ১৩ মার্চ শূন্যপদে স্থায়ী নিয়োগের সংশোধনীও জারি করে রেলওয়ে। কিন্তু এতে মামলার বাদীদের জন্য পদ বরাদ্দ রাখার কোনো নির্দেশনা দেখা যায়নি।
স্থগিতাদেশ থাকার মধ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করায় আদালতের নির্দেশ অমান্য করা হয়েছে বলে মনে করেন আইনজীবী আব্দুল্লাহ নাইম।