আজ মুক্তিযুদ্ধের ৫৯ বিদেশী বন্ধুকে সম্মাননা
আবদুল গাফ্্ফার খান, ফখরুদ্দীন আলী আহমেদ রয়েছেন এবারের এ তালিকায়
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য আরও ৫৯ ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানকে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ ও ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ দেবে বাংলাদেশ। এ জন্য মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সম্মাননা হিসেবে ২২ ভরি রূপার ওপর এক ভরি স্বর্ণ দিয়ে খচিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ পদক দেয়া হবে। সোমবার সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব) এ বি তাজুল ইসলাম এ কথা বলেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাঙালী যে অকৃতজ্ঞ জাতি নয়, সে কথা প্রমাণ করতেই এ আয়োজন। বাঙালী কৃতজ্ঞ জাতি, তা সম্মাননার মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হবে। তিনি বলেন, এই পদক বাঙালীর হৃদয়ের অর্ঘ্য বলতে পারেন। আর্থিক মূল্যের সঙ্গে এটি তুলনীয় নয়। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদে এটিই শেষ আনুষ্ঠানিক সম্মাননা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ সরকার যদি আবার ক্ষমতায় আসে তা হলে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে বাকিদের সম্মাননা প্রদান করা হবে। আর কোন কারণে এই সরকার যদি এবার ক্ষমতায় না আসে সে ক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত অবশিষ্ট বিদেশী বন্ধুদের সম্মাননা সেসব দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মারফত পাঠানো হবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য পদকপ্রদানে পাঁচ শ’র বেশি বিদেশী বন্ধু ও প্রতিষ্ঠানের নাম অন্তর্ভক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ছয় দফায় মোট ২৬৯ ব্যক্তি ও ৯ প্রতিষ্ঠানকে ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা’, ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’, ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা’ ও ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ পদক দেয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার হোটেল সোনারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিতব্য এ অনুষ্ঠানে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ফাকরুদ্দিন আলী আহমদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরালকে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ দেয়া হবে। তাঁদের পক্ষে এ পদক নিতে আসছেন তাঁদের সন্তান যথাক্রমে ড. পারভেজ আহমদ ও ড. তিজাস নায়েক। এটি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য সপ্তম দফা মৈত্রী সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান।
অন্য ৫৭ ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানকে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা মৈত্রী সম্মাননা’ দেয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছেন ভারতের ৪৮ জন, পাকিস্তানের ৩ জন, জাপানের ২ জন, মিসরের ১ জন, যুক্তরাজ্যের ২ জন, যুক্তরাষ্ট্রের ২ জন ও তুরস্কের ১ জন করে।
সম্মাননার তালিকায় রয়েছেন, ভারতের চিকিৎসক ও রাজনীতিবিদ ডা. জয়নাল আবেদীন, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী স্বপন কুমার ভট্টাচার্য, শিক্ষক ও সমাজকর্মী শ্রীমতি মৃন্ময়ী বোস, প্রযোজক ও অভিনেতা বিশ্বজিৎ রঞ্জন চ্যাটার্জি, সমাজকর্মী শ্যামল চৌধুরী, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব শ্রীমতি গৌরী ঘোষ, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব শ্রী পার্থ ঘোষ, বিমান বাহিনীর উয়িং কমান্ডার স্বরপ কৃষ্ণ কউল, মরণোত্তর লেখন ও সমাজকর্মী ড. আসগর আলী ইঞ্জিনিয়ার, মরণোত্তর সমাজকর্মী স্নেহাংশু কান্ত আচার্য, মরণোত্তর চিত্রশিল্পী সোমনাথ হোরে, মরণোত্তর রাজনীতিবিদ ও ইসলামিক চিন্তাবিদ মাওলানা সৈয়দ আসাদ মাদানী, মরণোত্তর রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী ভি, কে, কৃষ্ণ মেনন, মরণোত্তর সঙ্গীত শিল্পী সুচিত্র মিত্র পদ্মশ্রী, মরণোত্তর সমাজকর্মী এন, বি, মুখার্জি, মরণোত্তর সমাজকর্মী রবীন্দ্র মোহন চৌধুরী, মরণোত্তর আইনজীবী ও সমাজকর্মী আবুল ফজল গোলাম ওসমানী, মরণোত্তর ভারতীয় সেনাবাহিনীর লে. কর্নেল কুলওয়ান্ট সিং, মরণোত্তর সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার কিশোর পারেখ, মরণোত্তর সাবেক সরকারী কর্মকর্তা অশোক রায়, মরণোত্তর কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুভাস মুখোপাধ্যায়, মরণোত্তর অর্থনীতিবিদ সমর রঞ্জন সেন, মরণোত্তর কূটনীতিক সমর সেন, ভারতীয় সেনাসদস্য শহীদ সুবেদার মালকিত সিং মহাবীর চক্র, মরণোত্তর সুকদেব সিং সান্ধু এবং মরণোত্তর লে. জেনারেল তপিশ্বর নারায়ন রায়না মহাবীর চক্র। পাকিস্তানের মরণোত্তর রাজনীতিবিদ মাস্টার খান গুল, মরণোত্তর রাজনীতিবিদ খান আব্দুল ওয়ালী খান এবং মরণোত্তর রাজনীনিতবিদ খান আব্দুল গাফ্ফার খান। জাপানের সমাজকর্মী কেন আরি মিতসু ও মরণোত্তর সেনাকর্মকর্তা ও সমাজকর্মী লে. জেনারেল লইচি ফুজিওয়ারা। যুক্তরাজ্যের সমাজকর্মী এলিন কনেট ও অধ্যাপক ও সমাজকর্মী ড. পাউয়েল কনেট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকর্মী ম্যারি ফ্রান্সিস ডুনহাম এবং অধ্যাপক ড. আলফ্রেড সোমের । তুরস্কের মরণোত্তর সাংবাদিক ও সমাজকর্মী কেটিন ওজব্যার্ক এবং মিশরের প্রতিষ্ঠান এ্যাফ্রো-এসিয়ান পিপলস সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (এএপিএসও)।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য ইতোপূর্বে বাংলাদেশে মোট ছয় দফা সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়। এর মধ্যে সর্ব প্রথম দফায় প্রদান করা হয় ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে। মহান এই মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল প্রতিবেশি দেশ ভারত। এ ভূমিকার মূল নিয়ামকের ভূমিকা ছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর এই ঋণ বাংলাদেশ কখনও শোধ করতে পারবে না। এই কারণে মুক্তিযুদ্ধে সেই ধাত্রী স্বরূপ দায় পালনের জন্য ২০১১ সালের ২৫ জুলাই একমাত্র তাঁকেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ও সম্মান বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। সম্মাননা গ্রহণ করেন তাঁর পক্ষে ভারতীয় কংগ্রেস সভানেত্রী শ্রীমতী সোনিয়া গান্ধী। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ এ সময় শুধুমাত্র তাঁকেই এ মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করে।
দ্বিতীয় দফায় সম্মান প্রদান করা হয় ২০১২ সালের ২৭ মার্চ। এ সময় মোট ৮৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এর মধ্যে ৮ জনকে দেয়া হয় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা। এটি মুক্তিযুদ্ধে দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরস্কার। এ পর্যন্ত মোট ১৩ ব্যক্তিকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। এ ছাড়া দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করা হয় ৭০ ব্যক্তি ও ৬ সংগঠনকে। তৃতীয় দফায় সম্মাননা প্রদান করা হয় মোট ৬১ ব্যক্তিকে। ২০১২ সালের ২০ অক্টোবরের এই সম্মাননা অনুষ্ঠানে ২ ব্যক্তিকে প্রদান করা হয় দ্বিতীয় বৃহত্তম বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা এবং বাকি ৫৯ ব্যক্তিকে প্রদান করা হয় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা মৈত্রী সম্মাননা। ২০১২ সালের ১৫ ডিসেম্বর চতুর্থ দফায় ৬০ ব্যক্তি ও ২টি সংগঠনকে দেয়া হয় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা মৈত্রী সম্মাননা পদক। এ ছাড়া ২০১৩ সালের ৪ মার্চ পঞ্চম দফায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা প্রদান করা হয় ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জীকে। সর্বশেষ ষষ্ঠ দফায় ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ ২ ব্যক্তিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করা হয় ৬৬ ব্যক্তি ও ১ প্রতিষ্ঠানকে। এ দফায় মোট ৬৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই সম্মাননা পদক পান।
বাংলাদেশে অবস্থানকালে এই বিদেশী বন্ধুরা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করবেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করবেন বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসভূঁইঞা, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএস মাসুদ ইলাহী প্রমুখ।