আজ পবিত্র হজ
আজাদ সুলায়মান ॥ কাল মঙ্গলবার সেখানে পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। এ উপলক্ষে বিশ্বের ২৬ লাখ হজযাত্রী আজ মীনা থেকে আরাফাতের ময়দানে যাবেন। মীনায় ফজরের নামাজ আদায় করেই লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক ধ্বনিতে হজযাত্রীরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে নিজ নিজ খিমায় আশ্রয় নেবেন। এখানেই দিনভর এবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকবেন তাঁরা। আল্লাহর অশেষ রহমতের ময়দান আরাফাতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করার নামই হজ। এর আগে-পরে অন্য আনুষঙ্গিক কাজ করার মাধ্যমে হজের পরিপূর্ণতা দেয়া হয়।
মীনার মাঠ থেকে হজ পরিদফতরের পরিচালক বজলুল হক বিশ্বাস জনকণ্ঠকে বলেন, এবার কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে হজ পালনের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। আজ সোমবার ভোর থেকেই হজযাত্রীরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে সমবেত হবেন। তাঁদের বহন করার জন্য রয়েছে বিশেষ ট্রেন সার্ভিস। মীনা থেকে আরাফাতের দূরত্ব বেশি না হওয়ায় অনেকে হেঁটেও রওনা হবেন। তবে বাংলাদেশী হজযাত্রীদের বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে দেয়া হয়েছে। মীনার মাঠেও রয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা।
কিছু হজযাত্রী ফজরের নামাজের আগেই রাত তিনটার দিকে মীনার মাঠ থেকে আরাফাতের উদ্দেশে রওনা হবেন। আরাফাতের অবস্থান সম্পর্কে হাদিস শরিফে বলা আছে, হজের মোট ফরজ কাজ হচ্ছে ৩টি। ইহরাম বাঁধা, ৯ জিলহজ নির্দিষ্ট সময়ে উকুফে আরাফায় অবস্থান করা ও কাবাঘরে তাওয়াফ করা।
রবিবার মীনায় ছিল ২৬ লাখ হজযাত্রীর মিলনমেলা। এ বছর সারা বিশ্ব থেকে ২১ লাখ হজযাত্রী এবং সৌদি আরবের নিজস্ব আরও প্রায় ৫ লাখ হজযাত্রী হজ আদায় করবেন। তারা সবাই মীনার মাঠে গতকাল এবাদত বন্দেগীতে ব্যস্ত ছিলেন। লাখ লাখ সাদা তাঁবুতে সবাই পাশাপাশি অবস্থান করেন। অগ্নি দুর্ঘটনা এড়াতে এ বছরও মীনার মাঠে রান্না করে খাবার তৈরির কোন ব্যবস্থা নেই। এসব হজযাত্রীর সব খাবারই আসছে বাহির থেকে।
হজের প্রধান রুকন উকুফে আরাফায় আদায় করতেই হয়। তাই আজ মীনার মাঠে ফজরের নামাজের পর পরই হজযাত্রীরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও তামাম জিন্দেগীর গুনাহ মাফ করার একান্ত বাসনা নিয়ে রওনা দেবেন আরাফাত অভিমুখে। এখানে জোহরের ওয়াক্ত থেকে শুরু হবে উকুফের সময়। এদিন যোহরের ওয়াক্ত থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে ব্যক্তি আরাফায় উপস্থিত হবেন তাঁর জন্য সূর্যাস্ত পর্যন্ত উকুফ করা ওয়াজিব। কেউ সূর্যাস্তের পূর্বে পৌঁছতে না পারলে আগত রাতের সুবেহ সাদিক পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে কিছুক্ষণ অবস্থান করলেও উকুফের ফরজ আদায় হয়ে যাবে।
হাদিস মোতাবেক আরাফায় পৌঁছে উকুফের আগে গোসল করা সুন্নত। অনেকে গোসল না করে শুধু অজু করেই সামান্য খাবার খেয়ে নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন।
আরাফাতের মাঠে আজকের করণীয় হচ্ছে আরাফার কেন্দ্রবিন্দু মসজিদে নামিরার জামায়াতে অংশগ্রহণ করা। ইমামের পেছনে একসঙ্গে একই আজানে যোহর ও আছর আদায় করতে হয়। কিন্তু মসজিদে নামিরায় জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ায় নিজ নিজ খিমায় বা তাঁবুতে যোহর ও আছর আলাদা পড়ার নিয়ম। তবে এ নিয়ে মতবিরোধও রয়েছে। নিজের তাঁবুতে যদি কেউ মসজিদে নামিরার জামায়াতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যোহর ও আছর একত্রে পড়তে চান, সেটাও সহীহ্ হয়ে যায়। এ নিয়ে বিবাদে না জড়ানোই শ্রেয় বলে মনে করেন মসজিদে নামিরার খতিব।
হাদিস অনুযায়ী উকুফে আরাফায় অন্যতম করণীয় হচ্ছে দোয়া-মোনাজাত করা। এখানে দোয়া কবুল হওয়ার ওয়াদা রয়েছে। তাই পূর্ণ একীনের সঙ্গে দোয়া করতে হয়। উত্তম হচ্ছে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে একেবারে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দোয়া করা। এত দীর্ঘ সময় দাঁড়ানো কঠিন হওয়ায় প্রয়োজনে বসে বিশ্রাম নিয়ে আবার দাঁড়িয়ে দোয়া শুরু করা যেতে পারে।
হাদিসে রয়েছে আরাফাতের ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকার পর একজন হজযাত্রীর আসল হজ হয়ে যায়। সূর্যাস্তের পর সবাই হাজী হিসেবে গণ্য হবেন। আরাফাত ময়দান থেকে সূর্যাস্তের পর মাগরিবের নামাজ না পড়েই মুজদালিফার দিকে সব হাজী রওনা হবেন।
মুজদালিফার আমল ॥ আরাফাত থেকে এসে ৯ জিলহজ দিবাগত রাতে মুজদালিফায় অবস্থান করা সুন্নতে মুআককাদা। এদিন মাগরিব ও এশার নামাজ এক আজান ও এক ইকামতে মুজদালিফায় একত্রে পড়তে হবে। তবে অতিশয় বৃদ্ধ, নিতান্ত দুর্বল কিংবা অধিক পীড়িত রোগীর জন্য মুজদালিফায় অবস্থান না করে আরাফা থেকে সোজা মীনায় চলে যাওয়ার অনুমতি আছে। এ রাতে ঘুমানো ও আরাম করাই প্রধান আমল। কেননা মুসলিম শরীফের এক হাদিসে আছে, রাসুল (স) এ রাতে এশা পড়ে শুয়ে গেছেন। যেন সুবেহ সাদিকের পর উকুফের সময় দোয়া ও জিকিরে মশগুল থাকা যায়।
তবে বর্তমানে দেখা যায়, মুজদালিফায় হাজীরা সারা রাতই বিছানায় সজাগ অবস্থায় শুয়ে থাকেন। এ ছাড়া এখান থেকেই সংগ্রহ করতে হয় কঙ্কর। এসব কঙ্কর মারতে হবে মীনার মাঠের জামারায়। মুজদালিফায় ফজর নামাজ শেষে আগামীকাল (মঙ্গলবার ১০ জিলহজ) ২৬ লাখ হাজী একত্রে রওনা দেবেন ফের মীনার মাঠে। এদিন শুধু বড় শয়তানের ওপর কঙ্কর মারতে হয়।
হজের ইহরাম বাঁধার পর থেকেই এ পর্যন্ত সবচেয়ে উত্তম জিকির তালবিয়া পড়া এখানেই শেষ করতে হয়। কঙ্কর বা পাথর মারার নিয়ম হচ্ছে ১০ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্য ঢলে পড়া পর্যন্ত অর্থাৎ জোহরের সময়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পাথর মারা উত্তম। তবে অসুস্থ ব্যক্তিরা সূর্যাস্ত পর্যন্ত পাথর মারতে পারেন। তাও সম্ভব না হলে অন্য কেউ বদলি পাথর মারাও জায়েজ আছে। পাথর মারার পর তামাত্তু ও কিরান হাজীদের জন্য কোরবানি দেয়া ওয়াজিব। মীনার মাঠেই কোরবানির সুবন্দোবস্ত রয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশের হাজীরা সরকারী ও ব্যক্তিগতভাবে কোরবানি দিতে পারেন। কোরবানির পরই হাজীরা মাথা মু-ন করে হালাল হয়ে যান। এর পর আবার তাঁরা যাবেন মক্কা শরীফে। পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ করা ফরজ। তার পরের কাজটি সাফা মারওয়া সাতবার সায়ী করা ওয়াজিব। রাতে আবার হাজীরা ফিরে এসে মীনার মাঠে পর পর আরও ৩ দিন অবস্থান করে শয়তানকে পাথর মারার মধ্য দিয়ে শেষ করবেন ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ।
মীনার মাঠ থেকে হজ টিমের একজন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশের সব হজযাত্রীই ভাল আছেন। তবে রবিবার পর্যন্ত ৩৩ জন হজযাত্রীর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। এ ছাড়া কোন সঙ্কট বা সমস্যা নেই। এবার ২৬ লাখেরও বেশি হজ করার জন্য আরাফাতে জমায়েত হচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে সাড়ে সাড়ে ৬ লাখ সৌদি আরবের বাসিন্দা। বাকিরা বহির্বিশ্বের। এবারও মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক হজযাত্রী এসেছেন ইন্দোনেশিয়া থেকে। তারপরের সংখ্যাটি বাংলাদেশের প্রায় ৮৯ হাজার।
জেদ্দা থেকে প্রবাসী সাংবাদিক মেহেদী হাসান জনকণ্ঠকে জানান, নজিরবিহীন নিরাপত্তার মাঝে এবার হজ ব্যবস্থাপনা সাজানো হয়েছে। সুষ্ঠুভাবে হজ পালনের সুুবিধার্থে সৌদি সরকার ৯৫ হাজার নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। এ ছাড়া আরও ৪০ হাজার স্পেশাল ফোর্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এরা হাজীদের নামাজ আদায় ও পথঘাট দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করবেন। এবার হজ মনিটরিংয়ে অত্যন্ত উচ্চ প্রযুক্তির ক্যামেরা ব্যবহার করা হচ্ছে। হাজীদের নিরাপত্তায় বসানো হয়েছে চার হাজার দুই শ’ ক্যামেরা। গত সোমবার সংবাদ সম্মেলনে হজ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ বিভাগের কমান্ডার মেজর জেনারেল আব্দুল্লাহ যাহরানী এ তথ্য জানান। এ ক্যামেরাগুলো প্রতিকূল আবহাওয়াতেও ৬০ কি.মি. পর্যন্ত এলাকার তথ্য সরবরাহ করতে সক্ষম।
যাহরানী বলেন, জননিরাপত্তা বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল (ডিজি) আমাদের সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করার জন্য দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আর তাই আমরা নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চার হাজার দুই শ’ ক্যামেরা স্থাপন করেছি। গুরুত্ব বিবেচনা করে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। হজের সময়টাতে সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়াই এ বিভাগের মূল লক্ষ্য।
তিনি বলেন, সৌদি বিদ্যুত বিভাগ থেকেও হজ উপলক্ষে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রতিবছর সফলভাবে হজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সৌদি বিদ্যুত বিভাগ একটি বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। হজের সময় মক্কা, মীনা, আরাফাহ এবং মুজদালিফায় কমপক্ষে ২৫ লাখ মানুষের উপস্থিতি ঘটে। এই সময় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সৌদি বিদ্যুত বিভাগের চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) আলী বিন সালেহ আল বারাক হজের সময় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত ব্যবস্থার পরিকল্পনা অনুমোদন করেন।
হজ উপলক্ষে মক্কার বিদ্যুত ব্যবস্থা দেখার জন্য আল-বারাক সৌদি বিদ্যুত বিভাগের মক্কা অফিস পরিদর্শন করেন। পরে মক্কার গবর্নর প্রিন্স খালিদ আল ফয়সালের সঙ্গে সাক্ষাত করে তাদের প্রস্তুতির ব্যাপারে গবর্নরকে ওয়াকিবহাল করান। তিনি গত পাঁচ বছরে তাদের কাজের সফলতা এবং আগামী পাঁচ বছরে আরও আট হাজার চার শ’ পাঁচ মেগাওয়াট বিদ্যুত বৃদ্ধি করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। আর এ জন্য ৫১ বিলিয়ন রিয়ালের ২০০টি নতুন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।