ঢাকা: মাঘের শীতের কুয়াশায় ঢাকা টঙ্গীর তুরাগতীর। ভোরের পাখি ডেকে ওঠার আগেই লাখ লাখ মুসলি্লর কণ্ঠে আল্লাহু আকবার ধ্বনি। তাদের এ সুমধুর ধ্বনি যেন জানান দেয় মুসলিম উম্মাহর সম্প্রীতি চিরজাগরূক। মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিলনমেলা বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব চলছে সেখানে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় প্রিয় বান্দারা মশগুল জিকির ও বয়ানে। আজ রবিবার প্রথম পর্বের আখেরি মুনাজাত। বেলা ১১টা ৩১ থেকে ১১টা ৫৯ মিনিটের যে কোনো সময় মুনাজাত শুরু হবে। রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আজকের আখেরি মুনাজাতে অংশ নেবেন বলে জানা গেছে।
মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় জমায়েত বিশ্ব ইজতেমা গত শুক্রবার বাদ ফজর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুরু হয়েছে। লাখ মুসল্লির সঙ্গে জুমার নামাজে শরিক হতে সকাল থেকে টঙ্গীর আশপাশের এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে এসে হাজির হন। জুমার নামাজে ইমামতি করেন মাওলানা জুবায়ের।
এদিকে ইজতেমায় আগত আরও তিন মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। তাদের এখনো তাদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। এর আগে গতকালও দুই মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন-সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার মধ্য সেতুয়ালী গ্রামের হাজী আব্দুল মজিদ (৬৫) ও ঢাকার কেরানীগঞ্জের ওমর আলী (৪৮)। অসুস্থ হয়ে পড়লে টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে নেয়ার পথে তাদের মৃত্যু হয়। জুমার নামাজের পর দুই মুসল্লির নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে অংশ নিতে তাবলীগ জামাতের মুসল্লিরা গত বুধবার থেকেই ইজতেমাস্থলে আসতে শুরু করে। আগামী ২৬ জানুয়ারি রবিবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হবে। চার দিন বিরতি দিয়ে ৩১ জানুয়ারি শুরু হবে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। ২ ফেব্রুয়ারি (রবিবার) আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে।
বিশ্ব ইজতেমায় জুমার নামাজে স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান, গাজীপুর জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলাম, পুলিশ সুপার আব্দুল বাতেন এবং সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন।
বয়ান:শুক্রবার ফজর নামাজের পর আম বয়ানে শুরু হয় প্রথম পর্বের তিন দিনের ইজতেমা। ভারতের দিল্লির মাওলানা জুবায়ের হাসান, পাকিস্তানের মাওলানা ওবায়দুল হক ও মাওলানা ইসমাইল হোসেন বয়ান করেন। বাদ আসর বয়ান করেন দিল্লির মাওলানা জুবায়ের হাসান। বাদ মাগরিব বয়ান করেন দিল্লির মাওলানা সাদ।
প্রথম ধাপে ৩০টি জেলার ৪০টি খিত্তায় বৃহস্পতিবার ভোর থেকে লাখো মুসল্লি ইজতেমায় অবস্থান নেয়। দুই বর্গ কিলোমিটার এলাকায় কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। হাজার হাজার মুসল্লিকে রাস্তায় নামাজ পড়তে দেখা গেছে। বাদ মাগরিব নামাজের পর পাকিস্তানের মাওলানা ওবায়দুল হক আম বয়ান করেন। ভারতের দিল্লির মাওলানা ফারুক হোসেন প্রস্তুতিমূলক নিয়ম-কানুনের বয়ান করেন।
ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসারের কাজে আসা মুসল্লিদের বয়ান শোনার জন্য ইজতেমা মাঠের পশ্চিম পাশের মাঝামাঝি এলাকায় তৈরি করা হয়েছে বয়ান মঞ্চ। একই পাশে আরো রয়েছে নামাজ পড়ার মিম্বার, তাশকিলের কামরা, জামায়াত কক্ষ ও মোকাব্বির মঞ্চ। এছাড়া বয়ান শোনার জন্য মাইকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি রোদ ও কুয়াশা থাকায় খুঁটির ওপর তাবু ও অস্থায়ী ছাতি নির্মাণ করা হয়েছে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা: মুসল্লিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইজতেমা মাঠের প্রবেশ দ্বারে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রথম পর্বের ইজতেমার নিরাপত্তায় ১২ হাজার পুলিশ ও র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিয়েজিত রয়েছে। এছাড়া আনসার ও স্বেচ্ছাসেবকরাও রয়েছেন। বোমা নিষ্ক্রীয় করার জন্য রয়েছে বোমা ডিসপোজাল স্কোয়াড।
র্যাব-১ এর উপ-অধিনায়ক মেজর আহসানুল কবির বলেন, চারটি ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে কাজ করছে র্যাব সদস্যরা। পুরো ময়দানকে ঘিরে বিভিন্ন স্থানে থাকছে আটটি ওয়াচ টাওয়ার। সে সঙ্গে নৌ টহল ও চেকপোস্ট রয়েছে। এছাড়া দুইটি হেলিকপ্টারে এয়ার পেট্রোলিং চলছে।
বিদেশি মেহমানদের বিশেষ আপ্যায়ন: বিদেশি মেহমানরা প্রতি বছরের ন্যায় এবারো শতাধিক দেশের ৩০/৪০ হাজার মুসল্লি অংশগ্রহণ করবেন। এরই মধ্যে ১০ হাজারের অধিক মেহমান এসেছেন বলে জানিয়েছেন, মাঠের জিম্মাদার মাওলানা ফরিদ আহমেদ।
বিদেশি হাজারো মেহমানের জন্য মাঠের পশ্চিম-উত্তর কোণে নির্মাণ করা হয়েছে আলাদা কামরা। সার্বক্ষণিক তাদের দেখভাল করার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে টেলিফোন ইন্টারনেট থেকে শুরু করে রয়েছে সব ধরনের আধুনিক ব্যবস্থা। খাবারের ক্ষেত্রেও করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন। বিদেশি কামরার জন্য দুই শতাধিক জিম্মাদার রয়েছে বলে জানান মেহমান খানার জিম্মাদার মো. আজিজুল হক।
চিকিৎসা: মুন্নু গেট, এটলাস গেট, বাটা কারখানার গেট ও টঙ্গী হাসপাতাল মাঠসহ বিভিন্ন পয়েন্টে অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে বলে জানান গাজীপুর সিভিল সার্জন সৈয়দ হাবিবুল্লাহ। এছাড়া টঙ্গী হাসপাতালে বেড সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি হৃদরোগ, এজমা, ট্রমা, বার্ন ও চক্ষু ইউনিটসহ মোট আটটি ইউনিটে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিচ্ছেন। এছাড়া মুন্নু নগরের আশপাশে অর্ধশতাধিক ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। যেখান থেকে বিনামূল্যে ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে।
ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে হাজার হাজার মুসল্লিকে লাইন ধরে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে গাজীপুর সির্ভিল সার্জন ডা. শাহ্ আলম শরীফের তত্ত্বাবধানে মেডিকেল সেন্টার, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ফ্রি চিকিৎসা কেন্দ্র, হামমর্দ ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প, আঞ্জুমান আরা মুফিদুল ইসলাম, মারকাজুল ইসলাম, হোমিওপেথিক অনুশীলন কেন্দ্র, হোমিওপেথিক ফাউন্ডেশন, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিকেল, আয়ুবেদিক ফার্মাসিউটিকেল, ইসলামী মিশন, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, টঙ্গী ওষুধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি, ফাল্পুনি বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড, যমুনা ব্যাংক ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র: ইজতেমার মাঠে সব ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্থার বেশ কয়েকটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। যার মধ্যে নিউ মুন্নু ফাইন কটন মিল ক্যাম্পাসে রয়েছে জেলা প্রশাসন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), র্যাব, পুলিশ এবং বিদ্যুৎ বিভাগের বেশ কয়েকটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।
গাজীপুর জেলা প্রশাসক মো. নুরুল ইসলাম বলেন, প্রতিবারের মতো এবারো পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। যেখানে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবেন ১১ জন ম্যাজিস্ট্রেট। বিশ্ব ইজতেমার সার্বিক কর্মকাণ্ড সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে ঢাকা বিভাগীয় প্রশাসন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দিক-নির্দেশনায় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে বিভিন্ন কাজের তদরকি করা হচ্ছে।
সরকার বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য বিশেষ ট্রেন, বাস, লঞ্চ ও স্টিমারের ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মূল ইজতেমা ময়দানের সঙ্গে তুরাগ নদীর পশ্চিম তীরে যোগাযোগের জন্য ১০টি পন্টুন ভাসমান ব্রিজ নির্মাণ করেছে।
বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ঢাকা ওয়াসা ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এছাড়া আখেরি মোনাজাতের দিন সেনাবাহিনী এবং টঙ্গী অঞ্চল-০১ ট্যাংক লরির মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করবে।
বিশ্ব ইজতেমায় সার্বিক নিরাপত্তায় পুলিশ, আনসার, বিজিবি, র্যাব, সেনা ও নৌ বিমানবাহিনীসহ সরকারের অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার সদস্য মুসল্লিদের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত আছে। আগামী রবিবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হবে।