আগৈলঝাড়ায় দুঃস্থ নারীদের ভিজিডি কার্ডের চাল আত্মসাত
প্রেমানন্দ ঘরামী, বরিশাল ॥ বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের ১৮৫ জন দুঃস্থ নারীদের এক মাসের ভিজিডি কার্ডের ৫.৫৫০ টন চাল আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে চাল বিতরন না করেও মাস্টার রোলের মাধ্যমে চাল বিতরন করার এক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে দুঃস্থ নারীরা জেলা প্রশাসকের বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযোগের তদন্তে প্রমান পেলে কঠোর আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
দুঃস্থ নারীরা চাল না পেলেও উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের দাখিল করা মাস্টার রোলে উপজেলার ৪নং গৈলা ইউনিয়নে দু’বছর মেয়াদী ভিজিডি কার্ডের সুফলভোগী ৬নং ওয়ার্ডের ১২২নং কার্ডধারী মধ্যশিহিপাশা গ্রামের আবুল মোল্লার স্ত্রী পুতুল বেগম, ১২৪নং কার্ডধারী একই গ্রামের মৃত হারুন খলিফার স্ত্রী রুমা বেগম, ১২৯নং কার্ডধারী আজাহার শিকদারের স্ত্রী সাবিনা বেগম, ১৩০নং কার্ডধারী রুবেল শিকদারের স্ত্রী পারভীন বেগম, ১৩২নং কার্ডধারী খলিল ফরিয়ার স্ত্রী জাহানারা বেগম, ১৩৩নং কার্ডধারী দেবোতোষ ঘোষের স্ত্রী সীমা রানী ঘোষ, ১নং ওয়ার্ডের ১০নং কার্ডধারী নগরবাড়ি গ্রামের আনিস হাওলাদারের স্ত্রী কহিনুর বেগম, ৮নং ওয়ার্ডের ১৫৬ নং কার্ডধারী টিয়া মল্লিকের স্ত্রী বকুল বেগম, ৮নং ওয়ার্ডের সেরাল গ্রামের সাঈদ সেরনিয়াবাতের স্ত্রী হাসিনা বেগমসহ অন্যান্যদের চাল দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
এসব দুঃস্থ নারীদের অভিযোগে জানা গেছে, চলতি বছরের জুলাই মাসে তাদের কোন চাল দেয়া হয়নি। ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হোসেন লাল্টু ও স্থানীয় মেম্বররা তাদের বলেছেন, তাদের চাল আসেনি, পরবর্তীতে তাদের একত্রে দু’মাসের চাল দেয়া হবে। পরবর্তী আগস্ট মাসের চাল বিতরণের সময় দুঃস্থরা পূর্বের মাসের চাল দাবি করলে তাদের জানানো হয়, ট্রলার ভর্তি চাল ডুবে যাওয়ায় জুলাই মাসের চাল পরে দেয়া হবে। একই অভিযোগ করেন, ৮নং ওয়ার্ড সেরাল গ্রামের ভিজিডি কার্ডধারী খাদিজা বেগম, সেতারা বেগম, বকুল বেগম, ফিরোজা বেগম, রানু বেগম, ফরিদা বেগম, মাজেদা খানম, আয়শা খানম , জায়েদা বেগম, পেয়ারা বেগম, রুনু বেগম, হাওয়া বেগম, জাহানারা ও সোনিয়া বেগম। তারা দীর্ঘদিনেও তাদের প্রাপ্য চাল না পেয়ে আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আবুল কালাম তালুকদারের মাধ্যমে বরিশাল জেলা প্রশাসকের বরাবরে তাদের চাল আত্মসাতের অভিযোগ এনে চেয়ারম্যান সহ সংশ্লিষ্টদের বিচার দাবি করে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৩০ জুলাই ঈদুল ফিতরের জন্য প্রত্যেককে ১০কেজি করে গৈলা ইউনিয়নের ১ হাজার ৬’শ ৫ জনের অনুকূলে বিশেষ ভিজিএফ কার্ডের ১৬.০৫০ মে. টন চাল উত্তোলন করে ইউনিয়ন পরিষদ। জুলাই মাসের ভিজিডি’র অনুকূলে ৩১ জুলাই গোডাউন থেকে ১’শ ৮৫ জনের ৫.৫৫০ মে.টন চাল উত্তোলন করা হয়। এর তিনদিন পর ৪ আগস্ট ওই মাসের (আগষ্ট) ভিজিডি’র ৫.৫৫০ মে.টন চাল উত্তোলন করে গৈলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন লাল্টু। জুলাই মাসের চাল দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণ না করে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা এবং ওই ইউনিয়নের চাল বিতরণের তদারকি কর্মকর্তা (ট্যাগ অফিসার) আবুল কালাম আজাদের সহায়তায় ভুয়া মাস্টার রোল জমা দিয়ে ১৮৫ জন দুঃস্থ নারীর ভিজিডি’র চাল আত্মসাত করেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বরিশাল জেলা উত্তর বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন লাল্টু এবং তার অনুগত ইউপি সদস্যরা।
সূত্রমতে, ভিজিডি’র জুলাই মাসের চাল বিতরণের মাষ্টার রোল ১২আগষ্ট গৈলা/ইউপি/৪৯/২০১৩ নং স্মারকে দাখিল করা হলেও প্রতিবেদন ও মাষ্টার রোলে “মাস, বন্টন, পরিমান ও বরাদ্দের” জায়গায় ফ্লুইড টেম্পারিং করা হয়েছে। এছাড়াও দাখিল করা ওই মাস্টার রোলে ৩ আগস্ট চাল বিতরণের তারিখ লেখা থাকলেও চেয়ারম্যান ও তদারকি কর্মকর্তার স্বাক্ষর রয়েছে ১৩ আগস্টের। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জুলাই মাসের চাল ১৮৫জনের মধ্যে ৩০ কেজি করে বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণ শেষে কোন প্রকার ঘাটতি বা উদ্বৃত্ত চাল নেই।
এ ব্যাপারে ট্যাগ অফিসার ও উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাস্টার রোলে যাই থাক বা না থাক কার্ডধারীরা চাল পেয়েছে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। তিনি নিজে উপস্থিত থেকে চাল বিতরণ করেছেন বলেও উল্লেখ করেন। ভুক্তভোগীদের দায়ের করা অভিযোগ সম্পর্কে তিনি কোন সদূত্তর দিতে পারেননি।
গৈলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, বরিশাল জেলা উত্তর বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও আগৈলঝাড়া উপজেলা বিএনপির একাংশের (কুদ্দুস গ্র“পের) সাধারন সম্পাদক আবুল হোসেন লাল্টু জানান, দুঃস্থ নারীদের ভিজিডি’র জুলাই মাসের চাল শেষে বরাদ্দ পাওয়ায় একত্রে আগস্ট মাসেই দু’মাসের চাল বিতরণ করা হয়েছে। দু’একজনে চাল না নিলেও তা পরিষদে রয়েছে। দাখিল করা মাষ্টার রোলে বিভিন্ন তারিখ ও টেম্পারিং সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা ভুল হয়েছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ প্রাপ্তির সত্যতা স্বীকার করে ভিজিডি চাল বিতরণ কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আবুল কালাম তালুকদার বলেন, জুলাই মাসের চাল বিতরনের দাখিল করা মাস্টার রোল, অন্যান্য কাগজপত্রে বিভিন্ন অসংগতি রয়েছে। তিনি আরো বলেন, বিষয়টি তিনি নিজেই তদন্ত করবেন। তদন্তে অভিযোগ প্রমানিত হলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিগত ওয়ান ইলেভেনের সময় সেনা বাহিনীর সদস্যরা তৎকালীন ও বর্তমান গৈলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, বিএনপি নেতা আবুল হোসেন লাল্টুর বাড়ি থেকে আত্মসাতকৃত এক বান্ডিল ত্রাণের টিন উদ্ধার করেন। ওই ঘটনায় তিনি (আবুল হোসেন লাল্টু) দীর্ঘদিন কারাভোগ করে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান।