অবিশ্বাস্য পরাজয়

24/03/2016 9:54 amViews: 10

অবিশ্বাস্য পরাজয়

 

এক বল। দুই রান। অপেক্ষায় ষোলকোটি মানুষ। বত্রিশ কোটি চোখ তখন স্থির টিভি পর্দায়। শুনসান নীরবতা। শহরের ব্যস্ততম সড়কগুলোও চুপসে গেছে। গা হিম করা বল। দর্শকরা নড়েছেড়ে বসেছেন। অনেকেই দাঁড়িয়ে পরেছেন। কাঁধে হাত রেখে জয়গান গাইবেন। বিজয় মিছিলে সামিল হবেন। শেষ বলেই চিৎকারে আকাশ বিদীর্ণ করবেন। কিন্তু শেষ দৃশ্যে টাইগারদের এমন করুণ পরিণতি হবে, ঠিক এভাবে অবিশ্বাস্য পরাজয় দেখতে হবে এটা ভাবা সত্যিই ছিল যে কারো জন্যে কষ্টের। বোলিংয়ে ভারতকে কাঁপানো টাইগাররা সহজ জয়কে এমন কঠিন করে দেবে এটা কোনও অঙ্কেই হিসাব মিলছে না। ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলে এটাই একমাত্র আলোচনা। এ রকম একটি সুইসাইডাল গেম আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে সত্যিই এটা মানা যায় না। হৃদয় নিংড়ানো ষোলকোটি দর্শকের বত্রিশ কোটি চোখ জয়ের অশ্রু নিয়ে অপেক্ষার বদলে হিম হয়ে গেল মুহুর্তেই। টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার টেনের রোমাঞ্চকর ম্যাচে স্বাগতিক ভারতের কাছে ১ রানে হারল বাংলাদেশ। চিন্নাস্বামীতে এদিন জিততে শেষ ওভারে প্রয়োজন ১১ রান। প্রথম তিন বলেই ৯ রান সংগ্রহ জয়ে স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন মুশফিকুর রহীম ও মাহামুদুল্লাহ। শেষ তিন বলে জয়ের জন্য দরকার ২ রান। তখনই শুরু হলো আত্মহত্যা! প্রথম আত্মহত্যা করলেন মুশফিকুর রহীম। আগের দুই বলে দুটি চার মারা এই ব্যাটসম্যান হারদিক পান্ডের ফুলটস বলে ছক্কা মারতে গিয়ে তালুবন্দি হলেন কোহলির হাতে। তখনও বাকী দুই বল। ১৬ কোটি বাঙালির চোখ তখনও চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে। জিততে হলে প্রয়োজন ২ রান। সিঙ্গেল নিলেই যেখানে খেলা গড়ায় সুপার ওভারে। অবিশ্বাস্যভাবে একই ভুল করলেন মাহামুদুল্লাহ।  তিনিও মুশফিকুরের মতো গ্ল্যামার শট খেলতে গেলেন। ছয় মেরে খেলা শেষ করতে গিয়ে মাহামুদুল্লাহ ধরা পরলেন রবীন্দ্র জাদেজার বিশ্বস্ত হাতে। তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না, এমন ম্যাচে হারতে পারে বাংলাদেশ। কিন্তু হায়! হারদিক পান্ডের শেষ বল ব্যাটই স্পর্শ করাতে পারলেন শুভাগত হোম। মুস্তাফিজ পারলেন না দৌড়ে একটি রান চুরি করতে। ছুটে এসে স্টাম্প ভাঙলেন আগেই এক হাতের গ্লাভস খুলে প্রস্তুত থাকা ধোনি। ভাঙল বাংলাদেশের হৃদয়ও। পান্ডিয়া তখন উসাইন বোল্টের গতিতে মাঠে ছুটছেন। হতাশায় মুহ্যমান বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। হতাশ পুরো জাতি।
অঙ্কের হিসাবে ভারতের কাছে ২৩শে মার্চ সুখকর নয়। এমনি এক দিনে ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে বিশ্বকাপ ক্রিকেট থেকে ছিটকে পড়েছিল ভারত। ঠিক নয় বছর পর নিজ দেশের মাঠে টি-টোয়িন্টিতে এমন ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেলেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের বোকামিতে। দারুণ বোলিং-ফিল্ডিংয়ে ভারতকে দেড়শর ভেতরেই আটকে রেখেছিল বাংলাদেশ। রান তাড়ায় ওপেনিংয়ে তামিম পেয়েছিলেন নতুন সঙ্গী। তবে সঙ্গীর সঙ্গে দ্রুত বিচ্ছেদের ভাগ্য বদলায়নি। অশ্বিনকে ছক্কা মারতে গিয়ে ফিরেছেন মোহাম্মদ মিঠুন (১)। দ্বিতীয় উইকেটে তামিম-সাব্বিরের জুটিতে পথে ফিরেছে রান তাড়া। দুই দফায় জীবন পেয়েছেন তামিম। দ্বিতীয়টিতে খুবই সহজ ক্যাচ ফেলেছেন জাসপ্রিদ বুমরাহ। খানিক পর এই পেসারের এক ওভারে চারটি বাউন্ডারি মারেন তামিম। সাব্বির যথারীতি মিটিয়েছেন সময়ের দাবি। দুজনের সম্ভাবনাময় ইনিংসই শেষ হয়েছে স্টাম্পড হয়ে। রবীন্দ্র জাদেজার জোরের ওপর করা নিচু হওয়া বলে ফিরেছেন তামিম (৩২ বলে ৩৫)। সুরেশ রায়নার নিরীহ এক বলে মুহুর্তের জন্য পা তোলার খেসারত দিয়েছেন সাব্বির (১৫ বলে ২৬)। এরপর দলের হয়ে প্রতিরোধ গড়ে  তোলেন সাকিব আল হাসান। যেন আইপিএলের সব অভিজ্ঞতা ঢেলে দিতে চাইছেন। সাকিবের সঙ্গে ১৮ রানের ছোট্ট কিন্তু কার্যকর জুটি গড়ে ফিরেন মাশরাফি। রবিন্দ্র জাদেজার বলে বোল্ড হওয়ার আগে ৫ বলে ৬ রান করেন বাংলাদেশের অধিনায়ক। নিজের শেষ ওভারে আঘাত হানেন রবিচন্দন অশ্বিন। ১৫ বলে ২২ রান করা সাকিব আল হাসানকে ফেরান এই অফ স্পিনার। তার দারুণ এক ডেলিভারিতে স্লিপে ক্যাচ দেন সাকিব। ৯৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বিপদে পরে বাংলাদেশ। কিন্তু ওপেনিং থেকে সাতে ওঠে আসা সৌম্য সরকার ৬ষ্ঠ উইকেটে মাহমুদুল্লাহর সঙ্গে ৩১ রানে জুটি গড়ে আবারও আশার আলো দেখান। এর আগে টানা ৭ ম্যাচ টসে হেরেছেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মতুর্জা। এতে বাছাই পর্ব জয় দিয়ে উৎরাতে কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু ইডেনে পাকিস্তান ও চিন্নাস্বামীতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টস ফ্যাক্টর হলো। তাই ভারতের বিপক্ষে টিকে থাকার ম্যাচে টসে জয় যেন ছিল মঙ্গল বার্তা। ভারতকে ব্যাটিংয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে একটুও বুক কাঁপেনি মাশরাফির। শুরু থেকেই বারবার বোলার বদলে ভারতীয় ওপেনারদের স্থির হতে দেননি বাংলাদেশ অধিনায়ক। তার প্রথম ওভারটা সাদামাটা হলেও। পরের ওভার থেকে দারুণ নিয়ন্ত্রীত বোলিং। যার ফলে প্রথম ৫ ওভারে উইকেট না হারালেও রোহিত ও ধাওয়ানের মতো দুই মারমুখি ব্যাটসম্যান সফলতা মাত্র ২৭ রান। এরপর পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে  মুস্তাফিজকে দেখেই ভারতীয় দর্শকদের চিৎকার ‘ছয় চাই, ছয় চাই, ছয় চাই।’- দুটি বল জুতসই জায়গায় পেয়ে একটি রোহীত শর্মা অন্যটি শিখর ধাওয়ান ছক্কা মারেন দুই দর্শকদের মন ভরেন। কিন্তু মাঠে তখন দেখা গেল সহঅধিনায়কের ভূমিকা আইপিএলের অভিজ্ঞতা পুরুটাই যেন ঢেলে দিলেন। ওই ডেলিভারির ঠিক আগেই ডিপ স্কয়ার লেগ থেকে সাব্বিরকে বৃত্তের ভেতরে টেনে আনেন সাকিব ও মাশরাফি। ফাঁকা রেখে দেন অন সাইডে পুরো সীমানা। ফাঁদে পা দিয়ে সীমানা পার করতে গিয়েছিলেন রোহিত, ধরা পড়েন ভেতরে আনা সেই সাব্বিরের হাতেই। মুস্তাফিজের দারুণ স্লোয়ারটি  রোহিতকে তেতে ওঠার আগে বিদায় দেন ১৮ রানে। গ্যালারি জুড়ে নেমে আসে কবরের নিরবতা। এরপর থেকে ভারত যেন তার বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইন আপ নিয়ে আফসোসই করছিল। পরের ওভারেই ফুল লেংথ এক বলে সাকিব ফেরান ২৩ রান করা ধাওয়ানকে। উজ্জীবিত বাংলাদেশের বোলাররা চেপে ধরে নতুন দুই ব্যাটসম্যান কোহলি ও রায়নাকে। টানা ২৯ বলে ছিল না বাউন্ডারি। রানের জন্য ছটফট করতে থাকা দুই ব্যাটসম্যানই পান জীবন, যদিও দুটি ক্যাচই ছিল ভীষণ কঠিন। কোহলির ফিরতি ক্যাচ ফলো থ্রোতে হাতে জমাতে পারেননি আল আমিন। এক বল পরই স্কয়ার লেগ সীমানায় বল হাতে নিতে পারেননি শুভাগত, রায়না পান ছক্কা। পরের বলেই মারেন আরেকটি ছয়। শুভাগতর ফুলটসে কোহলির ছক্কায় জুটি স্পর্শ করে পঞ্চাশ। কিন্তু সেখানেই আবারও আঘাত। পরের বলেই স্লগ করতে গিয়ে বোল্ড হন ভারতের সেরা ব্যাটসম্যান কোহলি। দলের জন্য অবদান ২৪ রান। আগের ওভারে দুই ছক্কার জবাব দিলেন আল আমিন টানা দুই বলে উইকেট নিয়ে। ২৩ বলে ৩০ রান করা রায়নাকে সাব্বিরের ক্যাচ বানিয়ে শুরু। এরপর রান বাড়াতে প্রমোশন পাওয়া হারদিক পান্ডে ৭ বলে ১৫ রান করে বিপজ্জনক হয়ে উঠছিলেন। তিনিও শিকার আল আমিনের। তবে এই উইকেটি যদি সৌম্য সরকার নিজের দাবি করেন ভুল হবে না।  পান্ডের পুল শটে টাইমিং ছিল দুর্দান্ত, বল সীমানায় যাচ্ছিল বিদ্যুতের গতীতে। সৌম্য ছুটলেন, বল যখন নিচু হয়ে মাটি স্পর্শ করতে যাচ্ছে সৌম্য ঝাঁপালেন হাতে তুলে নিলেন। প্রেস বক্সে তখন বলাবলি বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা ক্যাচ এটি!  এরপর মাহমুদউল্লাহ প্রথম ওভারেই ফিরিয়ে দিলেন যুবরাজ সিংকে ৩ রান করে। শেষ দিকেও টানা ১৯ বলে হলো না বাউন্ডারি। আগের ওভারে অবশ্য ৩টি চার গুনেছেন আল আমিন। তবে শেষ ওভারে ধোনিকে বড় কিছু করতে দেননি মুস্তাাফিজ। রানটা তাই থাকল বাংলাদেশের নাগালেই। আল আমিন ৩৭ ও মুস্তাফিজ ৩৪ রান দিলেও ২ টি করে উইকেট এই পেসারদেরই দখলে। এছাড়াও শুভাগত, সাকিব ও মাহমুদুল্লাহ তিন স্পিনার মিলে নিয়েছেন একটি করে উইকেট।

Leave a Reply