অবসরের পর রায় লেখা বন্ধে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত
অবসরের পর রায় লেখা বন্ধ করে দিয়ে ঐতিহাসিক কাজ করেছেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। এর মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারের ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা হলো। গত বৃহস্পতিবার দুজন বিচারপতির লেখা ১৬৮টি রায় নতুন করে শুনানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এর মধ্য দিয়ে অবসরের পর রায় লেখার খারাপ নজিরের ইতি ঘটল। একইসঙ্গে বিচারপ্রার্থীদের বিলম্বে রায় পাওয়ার ক্ষেত্রে যে দুর্ভোগ তারও অবসান ঘটল। আর কার্যকর হলো ৫২ বছর আগে দেয়া সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়। স্বাধীনতার পর যে রায়কে না মানার প্রথা চালু হয়েছিলো আমাদের বিচারাঙ্গনে।
প্রধান বিচারপতি হিসেবে এসকে সিনহা দায়িত্ব গ্রহণের পর অবসরের পর রায় লেখা নিয়ে সাংবিধানিক বিতর্ক তৈরি হয়। খোদ জাতীয় সংসদ ছাড়াও বর্তমান ও সাবেক বিচারপতি এবং আইনমন্ত্রী বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, অবসরের পর রায় লেখা সংবিধানসম্মত নয়। তিনি আরো বলেছিলেন, ভারত ও পাকিস্তানে অবসরের পর রায় লেখা যায় না। অন্যদিকে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক জানিয়েছেন, অবসরের পর রায় লিখতে সাংবিধানিক বাধা নেই। তার ভাষ্যমতে, সংবিধানের কোথাও লেখা নেই অবসরের পর বিচারপতিরা রায় লিখতে পারবেন না।
সাংবিধানিক পদাধিকারীদের নিয়োগ কার্যকর হয় শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে এবং পদত্যাগ ও অবসরের মধ্য দিয়ে নিয়োগের অবসান ঘটে। এ কারণে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অবসরের পরে রায় লেখা সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। কেননা অবসরের পর বিচারপতির শপথ বহাল থাকে না এবং তিনি একজন সাধারণ নাগরিকে পরিণত হন। সুপ্রিম কোর্টের রুলসে অবসরের পর রায় লেখা যাবে কি যাবে না এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এম আসাদুজ্জামান ইত্তেফাককে বলেন, রায় তো বিচারপতিরা দেন, কিন্তু অবসরের পর সাধারণ নাগরিকে পরিণত হওয়া ব্যক্তি আদালতের নথি স্পর্শ করবেন কোন অধিকারে?
অবসরের পর রায় লেখার বিতর্কটি মূলত জোর পায় এই কারণে যে, স্বাধীনতার পর থেকেই অবসরের পর দীর্ঘকাল রায় না লিখে ফেলে রাখার খারাপ নজির চালু হয়েছিলো। যদিও আজ থেকে ৫২ বছর আগে এ রকম একটি বিতর্কের অবসান করেছিলো তত্কালীন সুপ্রিম কোর্ট। ১৯৬৪ সালে কাজী মেহারদিন বনাম মুরাদ বেগম মামলায় বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের তৈরি হয়েছিলো। অবসরের পর হাইকোর্টের একজন বিচারক একটি রায় লেখেন এবং তাতে স্বাক্ষর করেন। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলে সুপ্রিম কোর্টের তত্কালীন প্রধান বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াসের নেতৃত্বে পাঁচজন বিচারক এক রায় দেন। রায়ে বলা হয়, ‘অবসর পরবর্তী সময়ে কোনো বিচারপতির লিখিত ও স্বাক্ষরকৃত রায় কোনো রায় নয়।’ এই রায় এখনো বলবত্ আছে। কেননা উচ্চ আদালতের অন্য কোনো রায় দ্বারা এই রায় এখনো খণ্ডানো হয়নি।
আমাদের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, “আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যে কোনো বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয় হইবে।” অর্থাত্ সুপ্রিম কোর্টের কোনো আদেশ ও নির্দেশ, রায়, ডিক্রি ইত্যাদি মান্য করা সকল আদালতের বিচারকদের জন্য বাধ্যতামূলক। পাকিস্তান আমলে উচ্চ আদালতের দেয়া রায়ের ধারাবাহিকতা স্বাধীন দেশেও বহাল ছিলো (ক্ষেত্র বিশেষ ছাড়া)। অবসরের পর রায় দেয়া বেআইনি—এই নির্দেশনা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত মান্য করা হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অবসরের পরেও বিচারকরা রায় লিখতে থাকেন।
সম্প্রতি রাষ্ট্র বনাম শাহিদুর রহমান মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক ঐতিহাসিক রায় দেয়। রায়টি লিখেছেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। রায়ে বলা হয়েছে, মামলা নিষ্পত্তির ৬ মাসের মধ্যে রায় লিখতে হবে। বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নিয়েছেন পনের মাস আগে এবং বিচারপতি শামসুদ্দিন নিয়েছেন প্রায় সাত মাস আগে। তাদের লেখা ১৬৮টি রায় নতুন করে শুনানি গ্রহণ করে পুনরায় রায় দেবে আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগের এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে অবসরের পর রায় লেখার খারাপ নজিরের সমাপ্তি ঘটল।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার এম মাহবুবউদ্দিন এই সিদ্ধান্তকে যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিক বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, মামলা নিষ্পত্তির পরেও বিচারপ্রার্থীদের বছরের পর বছর রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হত। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বিচারপ্রার্থীদের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের অবসান ঘটবে।
আইনমন্ত্রীর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই
দুই বিচারকের কাছে থাকা ১৬৮টি মামলা পুন:শুনানির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, এ বিষয়ে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আমি এখনো বিস্তারিত জানি না। বিস্তারিত জানার পর এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া থাকলে তখন দেব।